অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। শনিবার রাতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে দলটির শীর্ষ নেতারা সরকারের উদ্দেশে একটি লিখিত বক্তব্য পেশ করেন। ওই বক্তব্যে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এবং রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিএনপি বলেছে—জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে সরকারের বাস্তব আচরণের ফারাক স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
বিএনপির লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের ফসল হিসেবে ২০২৪ সালের ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে এবং গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। জনগণ আশা করেছিল, এই সরকার হবে নিরপেক্ষ, দায়িত্বশীল ও জাতির প্রত্যাশার প্রতিফলন। কিন্তু বাস্তবে সরকার ক্রমেই সেই আদর্শ থেকে সরে আসছে বলে দাবি করেছে বিএনপি।
বিএনপি মনে করে, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা এখন বিভক্তির মুখে। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, এই ঐক্য যদি টিকে না থাকে, তাহলে তা জনগণের স্বপ্নভঙ্গেরই সামিল হবে। এমন পরিণতি দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে কিছু উপদেষ্টার ভূমিকা তুলে ধরেছে বিএনপি। তাদের মতে, যেসব উপদেষ্টা সরাসরি রাজনৈতিকভাবে যুক্ত, তারা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছেন। বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার ভূমিকা নিয়ে দলটি গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে। বিএনপির দাবি, তাঁর উপস্থিতিই সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
চট্টগ্রাম বন্দর ও মানবিক করিডোর ইস্যুতে সরকারের বক্তব্য ও সিদ্ধান্তকে নিয়ে বিএনপি স্পষ্ট আপত্তি জানিয়েছে। তাদের মতে, এ ধরনের জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার কেবলমাত্র জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারেরই রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ সাংবিধানিক পরিপন্থী এবং জনমতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বিএনপি জানিয়েছে, যদিও নির্বাচন কমিশন গঠনের সময় বিভিন্ন পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তবুও এর নিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। একাধিক মহল ইতোমধ্যেই কমিশন পুনর্গঠনের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে, যা প্রমাণ করে কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা এখনও সুদৃঢ় হয়নি।
এছাড়া, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ইশরাক হোসেনকে এখনো শপথ গ্রহণ করানো হয়নি—এই ঘটনাকে ‘আইনের শাসনের পরিপন্থী’ বলে আখ্যায়িত করেছে বিএনপি।
২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। দলটির মতে, জনগণের ভোটাধিকার, মানবাধিকার এবং সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার গঠন এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।
বিএনপি মনে করে, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা নির্বাচনের প্রস্তুতির সঙ্গে একযোগে চলতে পারে। একইসঙ্গে তারা জোর দিয়ে বলেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার প্রক্রিয়াও যেন অব্যাহত থাকে।
লিখিত বক্তব্যের শেষে বিএনপি হুঁশিয়ার করে বলেছে—বারবার প্রস্তাব ও পরামর্শ উপেক্ষিত হলে, সরকারকে পরামর্শ দেওয়া ও সহযোগিতার আগ্রহ ক্ষীণ হয়ে যাবে। দলটির দাবি, সরকার যদি সত্যিই জাতীয় ঐকমতের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার সদিচ্ছা দেখায়, তাহলে একটি কার্যকর ও গণমুখী পথচলা সম্ভব হবে।