সম্পাদক: মুহাম্মদ জাকির হোসাইন
ইসলাম কেবল একটি আধ্যাত্মিক বিশ্বাস নয়; এটি সামাজিক-নৈতিক একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। ইসলামের মৌলিক শিক্ষা—আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, ন্যায়, দয়া ও সদ্ব্যবহার—মানবতাবোধকে কেন্দ্রে রাখে।
কুরআন ও সুন্নাহে ধারাবাহিকভাবে মানুষের মর্যাদা, ন্যায়পরায়ণতা ও অন্যের অধিকার রক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই প্রশ্ন জাগে: “অমুসলিমদের প্রতি মুসলমানদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত?”
একজন মানুষ হতে পারে নাস্তিক, খ্রিষ্টান, ইয়াহুদী, হিন্দু বা বৌদ্ধ—এটা তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। ইসলাম প্রথমেই শিক্ষা দেয় অন্যকে সম্মান করার এবং মর্যাদা দেয়ার। কিন্তু আমরা, মুসলমানরাই, কি সত্যিই সেই সম্মান দিতে পেরেছি?
দুর্ভাগ্যবশত, আমরা আমাদের ধর্মের আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। সেই কারণে আজ আমরা লাঞ্ছিত ও অপমানিত। বিশ্বের মানুষের চোখে মুসলমানদের অবস্থান যেভাবে দেখা হয়, তার বড় কারণ হল আমাদের নিজের আচরণ। আমরা ইসলামের শিক্ষার মতো জীবনযাপন করি না, আমরা আদর্শের পথে চলি না।
একজন লোক যদি নাস্তিক হয়, সেটি তার স্বাধীনতা। আমাদের কর্তব্য হলো তাকে উত্তম আচরণ, উত্তম শব্দ ও সুন্দর দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বোঝানো। তবে একটি বিষয় মনে রাখা দরকার—নাস্তিকতাও, অন্য ধর্মের মতো, একটি বিশ্বাসের ধরন। আমরা যদি সেই ভিন্ন মতের মানুষদের সঙ্গে সহমর্মিতা ও যুক্তিসহ আচরণ করতে না জানি, তাহলে আমরা ভুলভাবে শক্তি প্রয়োগ করি—এটি ইসলামের শিক্ষা নয়।
দুর্ভাগ্যবশত, কিছু মুসলমান হিন্দুদেরকে “মালউন” অর্থাৎ অভিশপ্ত বলে গালি দেয়। আমরা বুঝি না যে এটি কত বড় পাপ। কুরআন ও সুন্নাহ অনুসারে, মালউন হতে পারে যে কেউ—এমনকি একজন মুসলমানও। যদি আপনি কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী চলেন না, যদি আপনি সুদ-ঘুষ গ্রহণ করেন, জিনায়াত বা অন্য অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন, অথবা পর্দা-শিষ্টাচার মেনে চলেন না, তবে আপনি নিজেও মালউন, অর্থাৎ অভিশপ্ত।
অতএব আমাদের প্রথমে নিজেদের দিকে তাকাতে হবে। আমাদের ধর্মের আদর্শকে জীবনের অংশ করে নিতে হবে।
আপনি কাউকে জোর করে আপনার ধর্ম চাপিয়ে দিতে পারবেন না। এটা নিষেধ। ইসলাম এমন সময়ে আগমন করে যখন আরব সমাজে ধর্মীয় বিভাজন, বর্ণবৈষম্য ও প্রতিহিংসা ছিল সর্বব্যাপী। এই প্রেক্ষাপটে ইসলাম ঘোষণা করে:
“لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ”
অর্থাৎ, “ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই।” — সূরা আল-বাকারা (২:২৫৬)
এই আয়াত ইসলামি সমাজে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহাবস্থানের ভিত্তি স্থাপন করে। ইসলামের এই মৌল নীতি প্রমাণ করে যে, অমুসলিমদের প্রতি মুসলমানদের আচরণ হওয়া উচিত মানবিক, ন্যায়নিষ্ঠ ও সদ্ভাবপূর্ণ।
কুরআনে বলা হয়েছে:
“لَا يَنْهَاكُمُ اللَّهُ عَنِ الَّذِينَ لَمْ يُقَاتِلُوكُمْ فِي الدِّينِ وَلَمْ يُخْرِجُوكُم مِّن دِيَارِكُمْ أَن تَبَرُّوهُمْ وَتُقْسِطُوا إِلَيْهِمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ”
অর্থ: “যারা তোমাদের সঙ্গে ধর্মের কারণে যুদ্ধ করে না এবং তোমাদের ঘরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়নি, আল্লাহ তোমাদের তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার ও ন্যায়পরায়ণতা করতে নিষেধ করেননি। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।” — সূরা আল-মুমতাহানাহ (৬০:৮)
এই আয়াতে ইসলামী আচরণের দুইটি মূলনীতি—ন্যায়পরায়ণতা (قسط) ও সদ্ব্যবহার (برّ)—প্রকাশ পেয়েছে। অর্থাৎ, মুসলমানরা এমন অমুসলিমদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে পারে, যারা বৈরিতা করে না। ইসলাম তাদের প্রতি দয়া, সহানুভূতি ও ন্যায্য আচরণকে প্রশংসনীয় বলে গণ্য করেছে।
কুরআনের দৃষ্টিতে ধর্মীয় স্বাধীনতা একটি মৌলিক অধিকার। আল্লাহ বলেন:
“لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ ۖ قَد تَّبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ”
“ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই; কারণ সৎপথ ও বিপথ পরিস্কারভাবে পৃথক হয়ে গেছে।” — সূরা আল-বাকারা (২:২৫৬)
এই আয়াতের মাধ্যমে ইসলাম ঘোষণা করেছে যে, কাউকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হারাম। ইসলাম আহ্বানের ধর্ম, জবরদস্তির নয়। এর ভিত্তি যুক্তি, চরিত্র ও মানবিক উদাহরণ।
কুরআনে আরও বলা হয়েছে:
“وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ”
“নিশ্চয়ই আমি আদমসন্তানদের সম্মানিত করেছি।” — সূরা আল-ইসরা (১৭:৭০)
এখানে “আদমসন্তান” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, “মুসলমান” নয়। এর মাধ্যমে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে, প্রত্যেক মানুষ—তার ধর্ম বা জাতি নির্বিশেষে—আল্লাহর সৃষ্টির মর্যাদা বহন করে। ইসলাম কোনো জাতি বা ধর্মকে অপমান করতে শেখায় না। বরং এটি শেখায় পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মানবিক মর্যাদা রক্ষা করতে।
আরেক স্থানে আল্লাহ বলেন:
“يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَىٰ وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا”
“হে মানুষ! আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো।” — সূরা আল-হুজুরাত (৪৯:১৩)
এ আয়াত স্পষ্ট করে যে, ধর্ম, জাতি বা বর্ণের পার্থক্য শত্রুতা বা বৈরিতার জন্য নয়, বরং পারস্পরিক জানাশোনার জন্য। তাই ইসলাম অমুসলিমদের সঙ্গে সহাবস্থান ও পারস্পরিক সহযোগিতাকে উৎসাহিত করেছে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ অমুসলিমদের সঙ্গে সদাচরণের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি বলেন:
“إِنَّ اللَّهَ رَفِيقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ، وَيُعْطِي عَلَى الرِّفْقِ مَا لَا يُعْطِي عَلَى الْعُنْفِ”
“আল্লাহ কোমল, তিনি কোমলতা ভালোবাসেন; আর তিনি কোমলতার মাধ্যমে যা দান করেন, তা কঠোরতার মাধ্যমে দান করেন না।” — সহীহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৯৩
নবী ﷺ এর জীবনেই আমরা দেখতে পাই যে, তিনি অমুসলিমদের প্রতি সহনশীল ও মানবিক আচরণ করতেন। তাঁর এক ইহুদি প্রতিবেশী অসুস্থ হলে তিনি খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন (সহীহ বুখারী)। আবার তিনি এক ইহুদির কাছ থেকে খাদ্য ক্রয় করে নিজের ঢাল বন্ধক রেখেছিলেন (সহীহ মুসলিম, হাদিস ৪০৩৪)। এসব উদাহরণ প্রমাণ করে, ধর্মের পার্থক্য মানবিক সম্পর্ককে সীমাবদ্ধ করে না।
নবী ﷺ বলেছেন:
“أَلَا مَنْ ظَلَمَ مُعَاهَدًا، أَوِ انْتَقَصَهُ حَقَّهُ، أَوْ كَلَّفَهُ فَوْقَ طَاقَتِهِ، أَوْ أَخَذَ مِنْهُ شَيْئًا بِغَيْرِ طِيبِ نَفْسٍ، فَأَنَا حَجِيجُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ”
অর্থ: “যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিভুক্ত (অমুসলিম) ব্যক্তির প্রতি জুলুম করবে, তার অধিকার হরণ করবে বা তার সম্মতি ছাড়া কিছু গ্রহণ করবে, আমি কিয়ামতের দিনে তার বিরুদ্ধে সাক্ষী হব।” — আবু দাউদ, হাদিস: ৩০৫২
এই হাদিসে নবী ﷺ অমুসলিম নাগরিকের প্রতি ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিমদের অধিকার মুসলমানদের নিকট অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।
আরেকটি বিখ্যাত হাদিসে বর্ণিত আছে, যখন নবী ﷺ-এর সামনে দিয়ে এক ইহুদির জানাজা যাচ্ছিল, তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন। সাহাবারা বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, এটি তো এক ইহুদির জানাজা।” নবী ﷺ বললেন,
“أَلَيْسَتْ نَفْسًا؟”
অর্থাৎ, “এটি কি প্রাণবন্ত মানুষ ছিল না?” — সহীহ বুখারী, হাদিস: ১২৫০
এটি প্রমাণ করে, ইসলাম এমনকি মৃত অমুসলিমের প্রতিও সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষা দেয়।
রাসূলুল্লাহ ﷺ মদীনায় আগমনের পর মুসলমান, ইহুদি ও অন্যান্য গোত্রের মধ্যে “মদীনার সনদ” প্রণয়ন করেন। এটি ছিল বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধানগুলোর একটি, যেখানে প্রত্যেক নাগরিককে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অধিকার দেওয়া হয়। পরবর্তীতে নবী ﷺ নাজরানের খ্রিস্টানদের সঙ্গে চুক্তি করেন, যেখানে তাদের চার্চ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
খলিফা উমর (রা.) যখন জেরুজালেম জয় করেন, তখন তিনি স্থানীয় খ্রিস্টানদের জীবন, সম্পদ ও ধর্মীয় স্বাধীনতা সুরক্ষিত রাখেন। তাঁর ঘোষণা ছিল: “তাদের গির্জা ধ্বংস করা হবে না, তাদের ধর্মে হস্তক্ষেপ করা হবে না।” এটি ইসলামী ন্যায়বিচারের এক অনন্য উদাহরণ।
বর্তমান যুগে মুসলমানরা নানা ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে সহাবস্থানে রয়েছে। ইসলামের এই আদর্শ এখনো সমানভাবে প্রযোজ্য। ইসলাম চায় পারস্পরিক সম্মান, সংলাপ, সহযোগিতা ও মানবিক সহানুভূতির ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তুলতে।
অমুসলিমদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ইসলামি সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলাম কখনো অন্য ধর্মকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে নয়, বরং ন্যায় ও মানবিকতা প্রতিষ্ঠার জন্য এসেছে।
তবে দুঃখজনকভাবে আজকের বিশ্বে কিছু মুসলমান কুরআন ও সুন্নাহর এই মহান আদর্শ ভুলে গেছে। রাজনৈতিক স্বার্থ, উগ্রবাদ ও সাংস্কৃতিক ভুল ব্যাখ্যা ইসলামের প্রকৃত বার্তা বিকৃত করছে। অথচ ইসলামের মূল শিক্ষা হলো—ন্যায়, সহনশীলতা ও দয়া। ইসলামে সন্ত্রাসবাদের ,জঙ্গিবাদের কোনো জায়গা নেই।
কোনো মুসলিম সন্ত্রাসী ,জঙ্গিবাদী হতে পারে না। আর কোনো সন্ত্রাসী ,জঙ্গিবাদী মুসলিম হতে পারে না ।
ইসলামের দৃষ্টিতে অমুসলিমও মানুষ—আল্লাহর সৃষ্টি। ইসলাম তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার, ন্যায্যতা ও সহনশীলতার নির্দেশ দেয়। নবী ﷺ-এর জীবন এই নীতির সর্বোত্তম উদাহরণ। কুরআনের ভাষায়,
“إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ”
অর্থাৎ, “আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।” — সূরা আল-মুমতাহানাহ (৬০:৮)
অতএব, একজন প্রকৃত মুসলমান কখনো অমুসলিমদের প্রতি বৈরিতা বা ঘৃণা প্রদর্শন করতে পারে না। বরং সে মানবতার প্রতিনিধি হিসেবে ন্যায় ও দয়ার মাধ্যমে ইসলামের সৌন্দর্য প্রকাশ করবে। ইসলাম ন্যায় ও করুণার ধর্ম, আর এর প্রকৃত অনুসারী সেই ব্যক্তি, যে প্রতিটি মানুষের সঙ্গে আচরণে সেই ন্যায় ও করুণাকে বাস্তবে রূপ দেয়।