1. desherchitrabd@gmail.com : Desher DesherChitra : Desher Chitra
রবিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৫, ১২:২২ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম :
বিএনপিকে হাসনাতের ইঙ্গিত: কাবিনে স্বাক্ষর করেছেন, সংসারও করতে হবে কুলাউড়ায় গলায় ফাঁস দিয়ে গৃহবধূর আত্মহত্যা জুলাই সনদে শেখ মুজিবের ছবি টাঙানোর বিধান অন্তর্ভুক্ত হয়নি, বিএনপির ক্ষোভ সংঘর্ষের রাজনীতি করলে আবার হাসিনার আমলে ফেরত যেতে হবে দুর্লভপুর ইউনাইটেড ক্লাবের নতুন কার্যকরী পরিষদ ঘোষণা – ২০২৫-২০২৭ আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুঁশিয়ারি শিশুকে চড়, বাবাকে গ্রেফতার: জেনেভা ক্যাম্পের ঘটনায় তদন্ত শুরু পারমাণবিক শক্তিতে চীন কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলছে রংপুরে চোর সন্দেহে যুবককে পিটিয়ে হত্যা রাজধানীর মিরপুরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের চেষ্টা

আরব বিশ্ব বনাম ইউরোপ ও আমেরিকা :মানবতার আলো ও অন্ধকারের গল্প

  • আপডেট টাইম : শনিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৫

সম্পাদক: মুহাম্মদ জাকির হোসাইন

মানবসভ্যতার ইতিহাসে এমন কিছু যুগ আছে, যেগুলো মানবতার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছেছিল—যেখানে ন্যায়, সমতা, সহানুভূতি, জ্ঞান ও মানবিকতার এক অসামান্য সংমিশ্রণ দেখা গিয়েছিল। সেই সোনালী যুগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ইসলামের সূচনাকাল, অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ ﷺ ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের যুগের আরব বিশ্ব।

তখনকার আরব সমাজ ছিল এক আশ্চর্য বিপ্লবের সাক্ষী। একদা যে মরুভূমি রক্তপাত, গোত্রবৈরিতা ও দাসপ্রথায় নিমজ্জিত ছিল, সেখানে ইসলাম এমন এক নৈতিক ও মানবিক দিশা দিল যা পরবর্তীতে গোটা বিশ্বের সভ্যতার গতিপথ পাল্টে দেয়।

রাসূলুল্লাহ ﷺ ঘোষণা করেছিলেন —

“তোমাদের কেউ প্রকৃত মুসলমান হবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্যও সেই কল্যাণ চায় যা সে নিজের জন্য চায়।”
(সহিহ বুখারি)

এই একটি বাক্যই আরব সমাজে নতুন এক মানবিক বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়। দাস, নারী, শিশু, গরিব—সবাই পেল মর্যাদা, পেল নিরাপত্তা। আরব সমাজ মানবতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, তা আজও ইতিহাসের সোনালী অধ্যায়।

সেই সময়ের আরব বিশ্ব শুধু ধর্মীয় দিক থেকেই নয়, জ্ঞান ও সভ্যতার ক্ষেত্রেও নেতৃত্ব দিয়েছিল। বাগদাদ, দামেস্ক, কায়রো, কর্ডোভা, বুখারা, সামরকন্দ—এসব শহর হয়ে উঠেছিল জ্ঞানের রাজধানী। চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, দর্শন ও নৈতিকতার চর্চায় মুসলমানরা তখন ছিল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি।

কিন্তু সময়ের প্রবাহে সেই স্বর্ণযুগ ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল। যে সমাজ একদিন মানবতার শিক্ষা দিয়েছিল, আজ সেই সমাজের অনেক অংশ মানবতাহীনতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আজকের আরব বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানকার চিত্রটি একেবারেই ভিন্ন। বিলাসিতা, রাজনীতি, ধর্মীয় ভণ্ডামি ও অর্থের অহংকারে মানবিক মূল্যবোধ অনেকাংশে হারিয়ে গেছে।

আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছিলেন—

“সবচেয়ে উত্তম মানুষ সে, যে মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে।”
(সহিহ বুখারি)

কিন্তু বর্তমান আরব সমাজের একটি অংশে এই শিক্ষাটি কেবল মুখের বুলি হয়ে গেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো—যেমন সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত—অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের শীর্ষে থাকলেও মানবিকতায় পিছিয়ে পড়েছে।

আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে, রাসূলুল্লাহ ﷺ এমন এক ঘোষণা দিয়েছিলেন, যা মানব ইতিহাসে সমতার সর্বোচ্চ উদাহরণ হয়ে আছে।
তিনি বলেছিলেন—

“হে মানুষ! তোমাদের প্রভু এক, তোমাদের পিতা এক। একজন আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই অনারবের ওপর,
আর কোনো শ্বেতাঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব নেই কৃষ্ণাঙ্গের ওপর—তবে শুধুমাত্র তাকওয়ার মাধ্যমে।”
(সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম)

এই ঘোষণা ছিল জাতিগত, বর্ণগত ও সামাজিক বৈষম্যের অবসান।
এমন উচ্চারণ ইতিহাসে আর কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নেতা করেননি।
তখনকার আরব সমাজে যেখানে বংশ, গোত্র ও জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার প্রবল ছিল,
রাসূল ﷺ সেই সমাজেই বললেন—
মানুষের মর্যাদা রঙ, ভাষা, বংশ বা সম্পদে নয়; বরং তাকওয়া, অর্থাৎ নৈতিকতা ও আল্লাহভীতিতে।

এই বক্তব্যে তিনি এমন এক সমতার সমাজের ভিত্তি স্থাপন করলেন, যেখানে এক দাস ও এক রাজা একই কাতারে দাঁড়ায়,
যেখানে নারী ও পুরুষ উভয়েই মানবতার অধিকারভুক্ত। এটি ছিল জাতিগত পার্থক্যের চূড়ান্ত অবসান ঘোষণা।

কিন্তু আজ, সেই জাতি—যারা একদিন এই ঘোষণা দিয়েছিল—তারা নিজেরাই বর্ণ, জাতি ও অর্থের ভেদাভেদে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
আরব সমাজে আজও অনেক জায়গায় শ্রমিকদের অবমূল্যায়ন করা হয় কেবল তাদের দেশের বা ত্বকের রঙের কারণে।
বাংলাদেশ, নেপাল, ফিলিপাইন, আফ্রিকা থেকে যাওয়া কর্মীদের প্রতি যে আচরণ করা হয়,
তা রাসূল ﷺ এর মানবিক ঘোষণার পরিপন্থী।

এগুলো আজকের আরব সমাজের বাস্তবতা।
জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, অনেক আরব দেশে অভিবাসী শ্রমিকদের বেতন বন্ধ, পাসপোর্ট জব্দ ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা নিয়মিতভাবে ঘটছে।

আরব সমাজের অনেক অংশে ধর্মীয় আচার পালিত হয়, কিন্তু সেই ধর্মের মূল বার্তা—মানবতা ও ন্যায়—অস্ফুট। যেন ধর্ম আছে, কিন্তু তার আত্মা নেই।

এখন যদি আমরা দৃষ্টি ঘুরি ইউরোপ ও আমেরিকার দিকে, দেখতে পাই এক ভিন্ন চিত্র। এই দেশগুলো ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে নাগরিকদের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রদান করে।
তারা শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে অগ্রগামী, কিন্তু তার চেয়েও বড়—তারা মানবিকতায় উন্নত।

একজন গৃহহীন মানুষও সেখানে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা পায়, একটি শিশুরও শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত হয়।
নরওয়ে, সুইডেন, জার্মানি, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র,যুক্তরাজ্য—এরা নাগরিককে “সম্পদ” হিসেবে দেখে, বোঝা হিসেবে নয়।
তাদের সমাজে ধর্মীয় বৈষম্য নেই, মানবাধিকার লঙ্ঘন নিন্দিত ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এমনকি তারা শরণার্থী আশ্রয়েও উদাহরণ স্থাপন করেছে। যখন সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইয়েমেনের মানুষ যুদ্ধের কারণে ঘরছাড়া হলো, তখন ইউরোপ-আমেরিকার বহু দেশ তাদের জন্য দরজা খুলে দিল।
জার্মানি একাই গ্রহণ করেছে প্রায় ১ মিলিয়ন সিরীয় শরণার্থী (UNHCR, 2023)।
কানাডা সরকার ২০১6 সালে চালু করে Private Sponsorship of Refugees Program, যেখানে সাধারণ মানুষ নিজের খরচে এক শরণার্থী পরিবারকে আশ্রয় দিতে পারে।

অন্যদিকে, ধনী আরব দেশগুলো—যাদের সঙ্গে ধর্ম ও ভাষার মিল—তারা রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে সীমান্ত বন্ধ রেখেছে।

একটি ভয়ানক সত্য হলো—বিশ্বে বর্তমানে যত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আছে, তার অধিকাংশই মুসলিম দেশ।
সিরিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তান, সুদান, ফিলিস্তিন—এই দেশগুলো আগুনে জ্বলছে।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, কেবল সিরিয়া থেকেই ৬.৮ মিলিয়ন শরণার্থী পালিয়েছে,
কিন্তু সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার কিংবা সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো আশ্রয় দেয়নি।

অন্যদিকে, ইউরোপীয় ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলো ধর্ম-বর্ণের পার্থক্য না দেখে মানবতার খাতিরে আশ্রয় দিয়েছে।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছিলেন:

“আমাদের দরজা তাদের জন্য উন্মুক্ত, যাদের দরজাগুলো আগুনে পুড়ে গেছে।”

এ দৃশ্য আমাদের জন্য লজ্জাজনক।
আমরা যারা মুসলমান, যারা নিজেদের মানবতার ধর্মের অনুসারী দাবি করি—আমরা কেন আমাদের ভাই-বোনদের পাশে দাঁড়াতে পারি না?
কেন ধনী আরব রাষ্ট্রগুলো তাদের সীমান্তে কাঁটাতার টেনে রাখে, আর ইউরোপীয় সমাজ খোলা বাহুতে গ্রহণ করে?

রাসূলুল্লাহ ﷺ মক্কা থেকে হিজরত করার সময় আনসার সাহাবারা মুজাহিরদের ঘরে স্থান দিয়েছিলেন, নিজের রুটিও ভাগ করে নিয়েছিলেন।
কিন্তু আজকের মুসলিম সমাজ সেই ইতিহাস ভুলে গেছে।

আরব বিশ্বের পতনের আরেকটি কারণ হলো শিক্ষায় পশ্চাৎপদতা ও প্রযুক্তিতে নির্ভরশীলতা।
যখন পশ্চিমা দেশগুলো নিজস্ব গবেষণা ও জ্ঞানচর্চায় অগ্রসর হয়েছে, তখন আরব বিশ্বের বড় অংশ তেলের আয়ে বিলাসিতায় নিমগ্ন থেকেছে।
শিক্ষা ও নৈতিকতা হারালে মানবতাও হারায়—এই সত্য এখন স্পষ্ট।

আজ পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞানের নতুন দিগন্ত খুলছে, আর আরব বিশ্বের বহু দেশ এখনও মৌলিক শিক্ষা সংকটে ভুগছে।
ফলে একসময় যারা জ্ঞানের আলোকবর্তিকা ছিল, তারা আজ ভাড়াটে শ্রমিক ও প্রযুক্তি আমদানিকারকে পরিণত হয়েছে।

মানবতা ধর্মের সীমা মানে না; এটি হৃদয়ের পরিধি মাপে।
আজকের ইউরোপ ও আমেরিকার সমাজ মানবতার দিক থেকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার কাছাকাছি চলে এসেছে, অথচ অনেক মুসলিম সমাজ সেই শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেছে।

ইসলামের মূল শিক্ষা হলো:

“তুমি যদি অন্যকে ক্ষতি না করো, তবে তুমি আমার উম্মতের অংশ।”
(সহিহ মুসলিম)

কিন্তু আজ দেখা যায়, ক্ষমতা, রাজনীতি ও অহংকার মানবতার জায়গা দখল করেছে।

মানবতার এই দ্বন্দ্বময় পৃথিবীতে আমরা এক গভীর নৈতিক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছি।
একদিকে ইউরোপ ও আমেরিকা মানবিকতার বাস্তব উদাহরণ দেখাচ্ছে, অন্যদিকে আরব বিশ্ব—যারা একদিন মানবতার শিক্ষক ছিল—তারা আজ সেই পাঠ ভুলে গেছে।

ইসলামের স্বর্ণযুগে একজন গরিব মানুষও মর্যাদা পেত; আজ বিলাসিতার রাজপ্রাসাদে থেকেও অনেক মানুষ আত্মিকভাবে নিঃস্ব।
আমরা যদি আবার সেই হারানো মানবতা ফিরে পেতে চাই, তবে ফিরে যেতে হবে কোরআন ও রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মূল শিক্ষায় ন্যায়, সমতা ও মমতার শিক্ষায় ।

যেদিন মুসলিম সমাজ আবার শিখবে নিজের ভাইয়ের চোখের অশ্রু মুছে দিতে,
সেদিনই আরব বিশ্ব আবার মানবতার আলোয় উদ্ভাসিত হবে,
আর পৃথিবী বুঝবে—ইসলাম কেবল একটি ধর্ম নয়,
এটি মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ দর্শন।

Share this Post in Your Social Media

Comments are closed.

এই ধরনের আরও খবর
Copyright © 2025, সাপ্তাহিক দেশের চিত্র. All rights reserved.
Weekly Desher Chitra developed by LogoMyface