দেশের চিত্র ডেস্ক
মৌলভীবাজার জেলা মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা, পাকিস্তানি সেনাদের দমননীতি এবং স্থানীয় জনগণের প্রতিরোধ এই জেলার ইতিহাসে একটি বিশেষ দাগ রেখে গেছে। এই সময়ে মৌলভীবাজারের বিভিন্ন গ্রাম ও শহরগুলোতে ঘটা ঘটনাগুলো স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্বকে আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানি সেনারা জেলার গ্রামাঞ্চলে প্রবেশ করে। তারা বিশেষভাবে মুক্তিকামী মানুষ এবং হিন্দু সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে তল্লাশি চালায়। গ্রামের মানুষদের ওপর নৃশংসতা চালানো হয় এবং অনেকেই নিরাপত্তার জন্য পার্শ্ববর্তী এলাকা বা ভারত সীমান্তে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এই পর্যায়ে স্থানীয় জনগণ আতঙ্কিত হলেও মুক্তিযোদ্ধারা গোপনে তাদের ঘাঁটি তৈরি করতে থাকে এবং স্থানীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
৬ থেকে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা ধাঁচের আক্রমণ শুরু করে। এই সময়ে কিছু গ্রাম ধ্বংস হলেও মুক্তিকামী শক্তির সাহসিকতা দৃঢ়ভাবে ফুটে ওঠে। স্থানীয় ঘাঁটি থেকে মুক্তিযোদ্ধারা সন্ত্রাসী বাহিনীর ওপর নিয়মিত আক্রমণ চালায়, যা পাকিস্তানি সেনাদের জন্য বড় ধরণের সমস্যার সৃষ্টি করে।
১১ থেকে ১৫ ডিসেম্বর ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় আশ্রয় নেওয়া স্থানীয় জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যৌথভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। মৌলভীবাজারের গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম ও সড়কপথে নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলে। এই সময়ে স্থানীয় জনগণও সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধে অংশ নেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের এই তৎপরতা পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ ব্যাহত করে এবং স্থানীয় মানুষের মনোবল বাড়ায়।
ডিসেম্বরের মধ্যভাগে, ১৬ থেকে ২০ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের যৌথ অভিযান শুরু হয়। এই যৌথ আক্রমণের ফলে পাকিস্তানি বাহিনী ধীরে ধীরে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে সরে আসে। স্থানীয় জনগণ স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপন করতে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা জেলা জুড়ে স্থায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে থাকে।
মাসের শেষদিকে, ২১ থেকে ৩১ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার প্রায় সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয়। স্থানীয় প্রশাসন পুনরায় নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপত্তা ব্যবস্থা দৃঢ় করার পাশাপাশি জনজীবন স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা চালায়। এই সময়ে মৌলভীবাজারে মুক্তিযুদ্ধের চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে—এটি ছিল স্থানীয় জনগণ ও মুক্তিকামী শক্তির সাহসিকতার প্রতিফলন।
মৌলভীবাজারের এই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুধু নির্দিষ্ট যুদ্ধকৌশলের বিষয় নয়, বরং এটি স্থানীয় জনগণের ধৈর্য, মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ ও সাহসিকতার ইতিহাস। এই জেলার মানুষ পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা সত্ত্বেও দমনে না ভেঙে প্রতিরোধের মূর্ত প্রতীক হিসেবে দাঁড়ায়। ডিসেম্বর ১৯৭১-এর এই ঘটনা দেশের স্বাধীনতা অর্জনে মৌলভীবাজারের অবদানকে চিরকাল স্মরণীয় করে রেখেছে।
মৌলভীবাজারের ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, স্বাধীনতা শুধু সেনা অভিযানের ফল নয়, এটি জনগণের সাহস, ঐক্য ও আত্মত্যাগের প্রতিফলন। ডিসেম্বর ১৯৭১-এর এই মাসটি ইতিহাসে মুক্তিকামী মানুষের সাহস ও মানবিক মূল্যবোধের একটি চিহ্ন হয়ে আছে।