দেশের চিত্র প্রতিবেদন
কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ আরও এক ধাপ জটিল রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে দলটির সভাপতি ও ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তির পর। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর থেকে প্রায় ১৫ মাস ধরে দলের নেতাকর্মীরা বিপর্যস্ত সময় পার করছিলেন; সর্বশেষ রায় সেই অনিশ্চয়তাকে আরও গভীর করেছে।
জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১ সোমবার শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। একই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হন। মামলার আরেক আসামি, পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন রাজসাক্ষী হওয়ায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
শেখ হাসিনা শুধু দলের প্রধান নন, বরং আওয়ামী লীগের পুরো রাজনৈতিক কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দু— সিদ্ধান্ত, নেতৃত্ব, নীতি নির্ধারণ সবই তার ওপর নির্ভরশীল ছিল। তার বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি। ফলে দলের প্রধান নেতার মৃত্যুদণ্ডের ফলে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, এবং স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসার সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে গেছে।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ একে ‘সাজানো’ এবং ‘পূর্বনির্ধারিত’ দাবি করে প্রত্যাখ্যান করেছে। দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী আরাফাত আন্তর্জাতিক মাধ্যমকে বলেন, “আদালত একটি সাজানো নাটকের মঞ্চায়ন করেছে। বিচার শুরুর আগেই রায়ের কাঠামো ঠিক করা ছিল।” মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ ছিল— উসকানিমূলক বক্তব্য, আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার নির্দেশ, রংপুরে আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড, চানখাঁরপুলে ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যা।
রায়ের পর নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ অনলাইনে রোববার ও সোমবার ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা এ ঘোষণা ঘিরে নতুন করে সক্রিয় হয়েছেন। ১৩ নভেম্বর ঢাকায় তাদের লকডাউন কর্মসূচির পর বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ, বাসে আগুনসহ সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে, যা জনমনে উদ্বেগ তৈরি করেছে। দলীয় সূত্র বলছে, সামনে আরও কঠোর কর্মসূচি আসতে পারে।
৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনা দেশ ছাড়েন। একই সময় দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা আত্মগোপনে চলে যান; অনেকেই বিদেশে পালিয়ে যান। ফলে দলটি কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে। পতনের পর কেন্দ্র থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়, অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। প্রকাশ্যে কোনো নেতাকে দেখা যায়নি এখনো।
পরবর্তীতে অন্তর্বর্তী সরকার দলের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। সভা–সমাবেশ, প্রচারণা, এমনকি অনলাইনেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। নির্বাচন কমিশনও দলটির নিবন্ধন স্থগিত করে।
দলটির প্রধান নেত্রী দণ্ডিত হলেও ভারত তাকে হস্তান্তর করবে না— এ বিশ্বাসে অটল আওয়ামী লীগের নেতারা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানায়, বিশেষ পরিস্থিতিতে দিল্লি তাকে সাময়িক মানবিক আশ্রয় দিয়েছে, এর বাইরে আর কিছু নয়।
সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগ এখন এক অনিশ্চিত মোড়ে দাঁড়িয়ে— দলের প্রধান নেত্রী দণ্ডিত, দল নিষিদ্ধ, নেতৃত্ব ছিন্নভিন্ন, অধিকাংশ নেতা আত্মগোপনে। এই অবস্থায় দলটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন দিকে মোড় নেবে, তা এখনো ঘনীভূত অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে।