1. desherchitrabd@gmail.com : Desher DesherChitra : Desher Chitra
রবিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:৩৮ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম :
শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করছে খালেদা জিয়ার বিদেশ যাত্রা: চিকিৎসক বাংলাদেশ পুলিশের দুর্নীতি: নতুন সরকারের দায়িত্ব ও জনমতের চাপ মৌলভীবাজারে লাইফলাইন হাসপাতালে অনিয়ম ও অবহেলার অভিযোগ ছাত্রদলের কমিটি গঠনে ২০ লাখ টাকা লেনদেনের অভিযোগ দক্ষিণ সুরমায় সাংবাদিকের বাসায় হামলা: ভাঙচুর, মারধর ও লুটপাট লন্ডন থেকে ঢাকায় পৌঁছে এভারকেয়ার হাসপাতালে যাচ্ছেন ডা. জুবাইদা খালেদা জিয়া বিদেশে যেতে পারবেন কি না—চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত চিকিৎসকদের: মির্জা ফখরুল বাংলাদেশে কারও নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই,তারেক রহমানের ফেরাকে ঘিরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার আশ্বাস জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপিতে যোগদানের ঢল: মির্জা ফখরুল ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে কেন্দ্র করে যুবদল নেতাকে মারধরের অভিযোগ, কাঠগড়ায় সিআইডি কর্মকর্তা

ধর্ম অবমাননা ও আমাদের সমাজ: সহনশীলতা, দায়িত্ব ও নৈতিকতার পুনর্গঠনের আহ্বান

  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৫

সম্পাদক: মুহাম্মদ জাকির হোসাইন

ধর্ম মানুষের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। জন্মের পর থেকেই মানুষ পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষার মাধ্যমে যে প্রথম পরিচয় লাভ করে তা হলো ধর্মীয় পরিচয়। অনেকের কাছে ধর্ম শুধু আধ্যাত্মিক চর্চা নয়, বরং পুরো জীবনের নৈতিক নির্দেশনা। তাই ধর্ম নিয়ে মানুষের আবেগ, শ্রদ্ধা এবং সংবেদনশীলতা স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত। কিন্তু যখন এই সংবেদনশীলতার অপব্যবহার হয় কিংবা কেউ ইচ্ছাকৃত বা ভুল বোঝাবুঝির কারণে ধর্মকে অবমাননা করে, তখন সমাজে উত্তেজনা, বিভেদ এবং সহিংসতা পর্যন্ত দেখা দেয়। বাংলাদেশের মতো ধর্মপ্রাণ সমাজে এ সমস্যা আরও জটিল, কারণ এখানে ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত অনুভূতির পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত।

আজকের বৈশ্বিক যোগাযোগমাধ্যম-নির্ভর যুগে ধর্ম অবমাননা বিষয়টি আরও দ্রুত ও বিস্তৃতভাবে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। অতীতে কোনো গুজব বা অপমানজনক বক্তব্য এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ছড়াতে সময় লাগতো, এখন একটি পোস্ট বা ভিডিও কয়েক মিনিটের মধ্যে হাজারো মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে। অনেক সময় সত্য-মিথ্যার যাচাই ছাড়াই মানুষ প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। যার ফলে ধর্ম অবমাননার অভিযোগকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, তা প্রায়শই বাস্তবতার চেয়ে আবেগের প্রতিক্রিয়া হয়ে দাঁড়ায়। এই সুযোগে অনেকে ব্যক্তিগত, সামাজিক বা রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে, যা সমাজকে আরও বিভক্ত করে। তাই ধর্ম অবমাননা নিয়ে আজকের আলোচনায় শুধু আবেগ নয়, বরং যুক্তি, মানবিকতা, নৈতিকতা, আইন ও সহনশীলতার দৃষ্টিভঙ্গি জরুরি।

ধর্ম অবমাননা বলতে সাধারণত এমন কোনো মন্তব্য, আচরণ বা প্রকাশকে বোঝানো হয় যার মাধ্যমে কোনো ধর্ম, নবী, পবিত্র গ্রন্থ, আচার বা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে ইচ্ছাকৃতভাবে অপমান করা হয়। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি এত সরল নয়। কেউ কেউ যুক্তিসঙ্গত সমালোচনা করলেও তা অন্যের কাছে অপমান বলে মনে হতে পারে। আবার অনেক সময় মানুষ কোনো বক্তব্যের প্রকৃত অভিপ্রায় না বুঝেই তা ধর্ম অবমাননা বলে ধরে নেয়। ধর্মীয় জ্ঞানের অভাব, ভুল ব্যাখ্যা, আবেগপ্রবণতা এবং রাজনৈতিক প্রভাব এই বিভ্রান্তিকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় এমন ঘটনা ঘটেছে যেখানে একটি ফেসবুক পোস্ট বা মন্তব্য পুরো এলাকাকে উত্তপ্ত করেছে, ঘরবাড়ি পুড়েছে, মানুষ আহত হয়েছে, এমনকি প্রাণহানিও ঘটেছে। পরে তদন্তে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে পোস্টটি ভুয়া ছিল, কেউ স্ক্রিনশট সম্পাদনা করেছিল, অথবা যাকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল তিনি এমন কিছু করেনইনি। এই বাস্তবতা আমাদেরকে দেখায় যে ধর্মীয় আবেগের সঙ্গে দায়িত্বশীল আচরণ না হলে তা সমাজের জন্য বড় ধরনের বিপদ বয়ে আনতে পারে।

একজন মুসলমান হিসেবে নিজের ধর্মকে রক্ষা করা যেমন দায়িত্ব, তেমনি অন্যের ধর্মকে সম্মান করাও ইসলামের শিক্ষা। ইসলাম সবসময়ই শান্তি, সহনশীলতা, ন্যায়বিচার এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। কুরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—অন্য ধর্মের পূজ্যবস্তুকে অপমান করলে তারা অজ্ঞতাবশত আল্লাহকেও অপমান করতে পারে। এ নির্দেশনার গভীর অর্থ হলো, ধর্মীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে শান্ত পরিবেশ বজায় রাখাই সর্বোচ্চ লক্ষ্য। তাই একজন মুসলমানের উচিত নিজের ধর্মকে ভালোবাসা ও পালন করা—কিন্তু সে ভালোবাসার নামে অন্য ধর্মকে অবমাননা করা কখনই ইসলামের নীতি নয়।

দুঃখজনক হলো, আজকের সমাজে কিছু ইসলামী বক্তা বা ধর্মীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ইসলাম প্রচারের নামে অমার্জিত ও অপমানজনক ভাষা ব্যবহার করেন, অন্য ধর্মকে হেয় করেন, অন্য মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধাচরণে উত্তেজিত করেন। এমনকি মুসলমানদের মধ্যেও একদল আরেকদলকে কটাক্ষ করেন। তারা মনে করেন যে তাদের ভাষণ ধর্মীয় জ্ঞান প্রচারের একটি পদ্ধতি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই আচরণ ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধের সাথে সম্পূর্ণ অসঙ্গত। ইসলাম কখনো বিদ্বেষ, গালি বা হিংসাকে প্রশ্রয় দেয় না। বরং ইসলাম যুক্তি, প্রজ্ঞা ও নরম ভাষার মাধ্যমে সত্যের পথ দেখাতে বলে। তাই এ ধরনের বক্তাদেরও আইনের আওতায় আনা জরুরি—শুধু তাই নয়, নৈতিকতার ভিত্তিতেও তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। আইন কারো জন্য বিশেষ সুবিধা রাখে না; বরং আইন সবার জন্য সমান। ধর্মীয় পরিচয় বা জনপ্রিয়তার আড়ালে বিদ্বেষ ছড়ানোর অধিকার কেউ পেতে পারে না।

ধর্ম অবমাননার সমস্যার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আন্তঃধর্মীয় সম্পর্কের দুর্বলতা। অনেক ক্ষেত্রে এক ধর্মের অনুসারীরা অন্য ধর্ম সম্পর্কে অল্পই জানেন। সীমিত বা ভুল জ্ঞানের কারণে ভুল ধারণা জন্মায়। তাই আন্তঃধর্মীয় সংলাপকে সমাজে গুরুত্ব দিতে হবে। যখন ভিন্ন ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বসে কথা বলেন, একে অপরের বিশ্বাস, আচার ও অনুভূতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন, তখন অনেক ভুল বোঝাবুঝি দূর হয়। মানুষ বুঝতে পারে যে ধর্ম ভিন্ন হলেও মানবিক মূল্যবোধ একই। আমরা সবাই শান্তি চাই, নিরাপত্তা চাই, সম্মান চাই। তাই আন্তঃধর্মীয় সংলাপ শুধু ধর্ম রক্ষার প্রক্রিয়া নয়, বরং একটি মানবিক সমাজ গঠনের জন্য অপরিহার্য।

ধর্ম অবমাননা নিয়ে উত্তেজনা কমাতে ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে আইনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে এ বিষয়ে আইন রয়েছে, কিন্তু আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে দ্বিধা, অসমতা এবং দীর্ঘসূত্রিতা দেখা যায়। মিথ্যা অভিযোগ থেকে শুরু করে বাস্তব অভিযোগের তদন্ত—সবক্ষেত্রেই নিরপেক্ষতা প্রয়োজন। ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করে কাউকে ফাঁসানো যেমন নৈতিকভাবে ভুল, তেমনি বাস্তব ধর্ম অবমাননার ঘটনায় দোষীদের শাস্তি না দেওয়াও সমাজের জন্য বিপজ্জনক। ন্যায়বিচার মানে হলো সত্য-অসত্য যাচাই করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া, আবেগ বা চাপের ভিত্তিতে নয়। তদন্ত, বিচার এবং আইন প্রয়োগ দ্রুত ও নিরপেক্ষ হলে মানুষ আইনের প্রতি আস্থা পাবে এবং আইন হাতে নেওয়ার প্রবণতা কমে যাবে।

ধর্ম অবমাননা প্রতিরোধে শিক্ষা ও সচেতনতার ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ছোটবেলা থেকেই শিশুদের শেখাতে হবে যে সব ধর্মের মানুষ সম্মান পাওয়ার অধিকারী। স্কুল, পরিবার, সমাজ—সব জায়গায় সহনশীলতা, মানবতা এবং অন্যের বিশ্বাসকে সম্মান করার মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মানুষ যখন বুঝবে যে অন্যকে অপমান করলে নিজের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাও ক্ষুণ্ণ হয়, তখন ধর্মকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে।

মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা নিয়েও কথা বলতে হয়। যাচাই-বাছাই ছাড়া ধর্ম সম্পর্কিত কোনো খবর প্রচার করলে তা দ্রুত উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। সাংবাদিকদের, ব্লগারদের এবং সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের দায়িত্বশীল আচরণ প্রয়োজন। ধর্ম নিয়ে সংবেদনশীল প্রতিবেদনে সাবধানতা জরুরি। একইভাবে সাধারণ মানুষেরও শিখতে হবে যে কোনো পোস্ট দেখেই প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে আগে সত্য যাচাই করতে হবে। মিথ্যা তথ্য যে কত বড় ক্ষতি করতে পারে তার উদাহরণ আমাদের সমাজে কম নয়।

অবশেষে বলা যায়, ধর্ম অবমাননা মূলত সামাজিক, নৈতিক, রাজনৈতিক এবং মানসিক জটিলতার একটি সমষ্টি। এটি শুধুই একটি ব্যক্তিগত অপরাধ নয়; বরং এর প্রভাব গোটা সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। তাই এর সমাধানও হওয়া উচিত বহুমাত্রিক। নিজের ধর্ম রক্ষা, অন্য ধর্মের প্রতি সম্মান, বক্তাদের জবাবদিহিতা, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ, ন্যায়বিচার, শিক্ষা ও নৈতিকতা—সবকিছুকে একসঙ্গে বিবেচনা করলেই একটি সুস্থ সমাজ গড়ে উঠতে পারে।

ধর্ম আমাদের বিভাজন নয়; বরং মানবিকতা, শান্তি ও নৈতিকতার পথ দেখায়। তাই ধর্ম অবমাননার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে আবেগের পাশাপাশি প্রজ্ঞা ও সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। আমরা যদি সত্যিই নিজেদের ধর্মকে ভালোবাসি, তবে প্রথম দায়িত্ব হলো শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল সমাজ গঠন করা, যেখানে কেউ কারও বিশ্বাসকে আঘাত করবে না, আর কেউ অন্যের ওপর আঘাত করতে আইনের বাইরে যাবে না। মানুষ মানুষের জন্য—এ সত্যটি ধর্মের মূল চেতনার সাথেও অদ্ভুতভাবে মিল খুঁজে দেয়। তাই আমাদের উচিত ধর্মকে বিভেদের নয়, বরং একতার আলো হিসেবে দেখতে শেখা।

Share this Post in Your Social Media

Comments are closed.

এই ধরনের আরও খবর
Copyright © 2025, সাপ্তাহিক দেশের চিত্র. All rights reserved.
Weekly Desher Chitra developed by LogoMyface