শাহনাজ আক্তার তামান্না
বাংলাদেশে মব সন্ত্রাস বা জনতার হাতে আইন হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই প্রবণতা যেভাবে বেড়ে উঠেছে, তা মানবাধিকার সংস্থা ও নাগরিক সমাজের জন্য উদ্বেগজনক সংকেত। শেখ হাসিনার দীর্ঘ ক্ষমতাকাল (২০০৯–২০২৩) জুড়ে এমন ঘটনা ঘটলেও সাম্প্রতিক সময়ে—বিশেষত ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত—পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে এক অভূতপূর্ব উল্লম্ফন।
এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো পরিসংখ্যান, কারণ, প্রভাব ও সম্ভাব্য সমাধানের পথ—যাতে পাঠক ও নীতিনির্ধারক উভয়েই একটি স্পষ্ট চিত্র পান।
এক দশকেরও বেশি সময়ের চিত্র
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে মানবাধিকার সংগঠনগুলো নিয়মিতভাবে মব সন্ত্রাসের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ ও নথিবদ্ধ করেছে। Ain o Salish Kendra (ASK)-এর তথ্য অনুযায়ী, এই সময়সীমায় প্রতি বছরই গড়ে কয়েক ডজন থেকে শতাধিক মানুষ জনতার হাতে নিহত হয়েছেন।
কিছু বছর তুলনামূলকভাবে শান্ত থাকলেও, বিশেষ কিছু সময়—যেমন গুজব ছড়িয়ে পড়া বা রাজনৈতিক অস্থিরতার মুহূর্তে—সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে গেছে। ২০১৮ সালে ‘শিশু অপহরণ’ গুজবের পর দেশজুড়ে একাধিক লিঞ্চিং ঘটেছিল। তখন এক মাসেই ১০ জনের বেশি মানুষ মারা যায়।
২০২৪: রেকর্ড ভাঙার বছর
Human Rights Support Society (HRSS) এবং একাধিক জাতীয় সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সাল মব সন্ত্রাসের ঘটনায় গত এক দশকের রেকর্ড ভেঙেছে। শুধু বছরের প্রথম সাত মাসেই HRSS নথিভুক্ত করেছে ১১৯টি মৃত্যুর ঘটনা। একই সময়ে Ain o Salish Kendra-র তথ্যে মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি।
সর্বাধিক ভয়াবহ প্রবণতা দেখা যায় ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে—রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট, এবং সামাজিক মাধ্যমে গুজবের বন্যা মিলে এক অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করে। বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিদিনই একাধিক লিঞ্চিংয়ের খবর আসতে থাকে। কিছু রিপোর্টে বলা হয়েছে, আগস্ট থেকে বছরের শেষ পর্যন্ত ২০০-রও বেশি মানুষ মব সন্ত্রাসে প্রাণ হারিয়েছে। তবে উৎসভেদে সংখ্যা কিছুটা কমবেশি।
২০২৫: উর্ধ্বগতি বজায়
২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই (জানুয়ারি–জুন) একাধিক মানবাধিকার সংগঠন জানায়, মৃত্যু ও আঘাতের সংখ্যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি। Ain o Salish Kendra-র তথ্যে দেখা যায়, এ সময়েই শতাধিক মৃত্যু ঘটেছে। কিছু রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, আগস্ট ২০২৪ থেকে জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত এক বছরে ৬০০+ মব-ভায়োলেন্স ঘটনা ঘটেছে—যার অনেকগুলোই প্রাণঘাতী।
মব সন্ত্রাসের প্রকৃতি
বাংলাদেশে মব সন্ত্রাস সাধারণত নিম্নলিখিত কারণগুলোর পটভূমিতে ঘটে থাকে—
আঞ্চলিক বিস্তার
ASK ও HRSS-এর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাইরে বিশেষত গ্রামীণ ও উপজেলা পর্যায়ে এসব ঘটনার হার বেশি। রাজধানীতে ঘটনা ঘটলেও তা তুলনামূলকভাবে কম, কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি বেশি।
মফস্বল এলাকাগুলোতে একবার গুজব ছড়িয়ে পড়লে প্রতিরোধ ব্যবস্থা কার্যকর হওয়ার আগেই মব-হিংসা ঘটে যায়।
প্রভাব: সামাজিক ও রাজনৈতিক
মব সন্ত্রাস কেবল প্রাণহানি ঘটায় না, সমাজে ভয় ও অবিশ্বাসের সংস্কৃতি তৈরি করে।
বিশেষজ্ঞদের মত
মানবাধিকারকর্মী ও সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, এটি মূলত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ব্যর্থতা ও সামাজিক সচেতনতার অভাবের ফল।
একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “মব সন্ত্রাস প্রতিরোধের মূল উপায় হলো দ্রুত প্রতিক্রিয়া ও সঠিক তথ্য প্রচার। যতো দ্রুত মিথ্যা গুজব খণ্ডন করা যাবে, ততই সহিংসতা ঠেকানো সম্ভব।”
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও মব সন্ত্রাস একটি বড় সমস্যা। তবে বাংলাদেশে সামাজিক মিডিয়ার গুজব এবং আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে এটির প্রাবল্য বেশি।
Human Rights Watch এক প্রতিবেদনে বলেছে—বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি মব সন্ত্রাসের বিস্তারকে ত্বরান্বিত করছে।
সমাধানের পথ
প্রবণতা কমাতে বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি পদক্ষেপের কথা বলছেন—
শেখ হাসিনার শাসনামল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত বাংলাদেশের মব সন্ত্রাসের পরিসংখ্যান স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে—এটি কেবল একটি আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের প্রতিফলন। সাম্প্রতিক বছরগুলোর ভয়াবহ উল্লম্ফন সতর্কবার্তা দিচ্ছে—যদি অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে এটি আরও গভীর সামাজিক বিভাজন ও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
মব সন্ত্রাস রোধ করতে হলে শুধু আইন প্রয়োগ নয়, প্রয়োজন জাতীয় পর্যায়ে সচেতনতা, শিক্ষা, এবং সঠিক তথ্য প্রচারের এক সমন্বিত উদ্যোগ। নইলে প্রতিটি নতুন ঘটনা আমাদের সভ্যতার মানদণ্ডকে আরও নিচে নামিয়ে আনবে।