মৌলভীবাজার প্রতিনিধি
মৌলভীবাজার জেলায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা এখন আর কেবল সামাজিক উদ্বেগ নয়, রীতিমতো প্রাণঘাতী বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে। জেলার শহর ও আশপাশের এলাকায় কিশোর গ্যাং সদস্যদের তাণ্ডব বেড়েই চলেছে। তারই মর্মান্তিক উদাহরণ হিসেবে সম্প্রতি খুন হয়েছেন জেলার এক বিশিষ্ট আইনজীবী সুজন মিয়া।
হত্যাকাণ্ডের বিবরণ
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত কয়েকদিন পূর্বে। রাতে মৌলভীবাজার শহরের কাশীনাথ এলাকায় এক কিশোর গ্যাং সদস্যের সঙ্গে সুজন মিয়ার সামান্য কথা কাটাকাটি হয়। এরপর রাত ৯টার দিকে বাড়ি ফেরার পথে সুজন মিয়াকে ঘিরে ধরে ৫-৬ জন কিশোরের একটি দল। ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করলে ঘটনাস্থলেই তিনি গুরুতর আহত হন। স্থানীয়রা দ্রুত মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহত সুজন মিয়ার পরিচয়
৪২ বছর বয়সী সুজন মিয়া মৌলভীবাজার জেলা জজ কোর্টের একজন প্র্যাকটিসিং আইনজীবী ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার ও সমাজ উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন জেলা আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দ, স্থানীয় সাংবাদিক সমাজ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠন।
কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান: কী বলছে স্থানীয়রা?
বিগত এক বছর ধরেই মৌলভীবাজার শহরের বিভিন্ন পাড়ায় গড়ে উঠেছে ছোট-বড় কিশোর গ্যাং। এদের অনেকেই স্কুল-কলেজ ছেড়ে দিয়ে মাদক, ছিনতাই এবং চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন,“রাতে তো আর বের হতেই পারি না। মোবাইল-টাকা ছিনতাই তো প্রায়ই হচ্ছে। পুলিশ ধরলেও পরে শুনি আবার ছাড়া পেয়ে যায়।”
পুলিশের অবস্থান
ঘটনার পর পরই মৌলভীবাজার সদর থানার পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৪ জন সন্দেহভাজন কিশোরকে আটক করেছে। জেলা পুলিশ সুপার মো. জাকারিয়া এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন,
“এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কিশোর গ্যাং ‘ব্ল্যাক টিম’ জড়িত বলে আমরা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছি। বাকি আসামিদের ধরতে অভিযান চলছে। এই গ্যাং সদস্যদের অনেকের বিরুদ্ধে পূর্বে মাদক, ছিনতাইসহ একাধিক মামলা রয়েছে।”
বিশেষজ্ঞ মতামত
সামাজিক গবেষক ড. শাহনাজ পারভীন বলেন,
“এখনকার কিশোরেরা একটা ভ্যাকুয়ামে আছে—পারিবারিক তদারকি কম, সামাজিক দায়িত্ববোধ নেই, আবার ইন্টারনেট-সোশ্যাল মিডিয়ায় সহিংসতা দেখে তারা অনুপ্রাণিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বড় দুর্ঘটনা তো ঘটবেই।”
প্রতিরোধে কী করা দরকার?
কিশোর গ্যাং চিহ্নিত করে স্কুল ও কলেজে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম চালানো
অভিভাবকদের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করা
যুব উন্নয়ন অফিস, এনজিও, ও প্রশাসনের সমন্বয়ে গ্যাংবিরোধী বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন,সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করা
সুজন মিয়ার মৃত্যু আমাদের একটি কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে—আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তবে মৌলভীবাজারের কিশোররা যে শুধুই বিপথে যাবে তাই নয়, সমাজকেও করে তুলবে ভয়ংকরভাবে অনিরাপদ।