সম্পাদক : মুহাম্মদ জাকির হোসাইন
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা একটি সাহসী পেশা, তবে বর্তমানে সেই সাহসিকতার জন্য যে নিরাপত্তার প্রয়োজন, তা ক্রমেই হুমকির মুখে পড়ছে। দেশে সংবাদ সংগ্রহ এবং সাংবাদিকতা করার স্বাধীনতা এক সময় যেখানে রুদ্ধ ছিল, এখন তাও বিন্দু-বিন্দু সংকটের মধ্যে পড়ছে। বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা, যেটি গণতন্ত্রের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, তা আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিশ্লেষকদের মতে, সাংবাদিকদের নিরাপত্তাহীনতা একদিকে যেমন মানবাধিকার ও স্বাধীনতার সংকট সৃষ্টি করছে, তেমনি এটি গণমাধ্যমের ভূমিকা নষ্ট করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক রাশেদা চৌধুরী বলেন, “একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সাংবাদিকরা শাসক গোষ্ঠীকে প্রশ্নবিদ্ধ করার এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা সংকটে পড়ে গেলে, তারা তাঁদের কাজ যথাযথভাবে করতে পারেন না। এ কারণে গণতন্ত্রের পরিপূর্ণ বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।” তাঁর মতে, সাংবাদিকদের নিরাপত্তার অভাব রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা কমিয়ে দেয় এবং এর ফলে জনগণের মৌলিক অধিকারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ও বাংলাদেশে সাংবাদিকদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, “যখন সাংবাদিকরা ভয় ও নির্যাতনের শিকার হন, তখন তাদের কাজের স্বাধীনতা ও জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকার বিপন্ন হয়।”
বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে সাংবাদিকদের উপর হামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪ সালে “বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন” (বিএফইউজে) এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানায় যে, ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৫০টিরও বেশি সাংবাদিক বিভিন্ন ধরনের শারীরিক হামলা ও হুমকির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনা সরকারি দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে, যা সরকারের দায়িত্বহীনতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার প্রতিফলন।
এছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, যা সাংবাদিকদের স্বাধীনতায় আরও এক ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার প্রভাবও গভীর। এই আইনের আওতায় সাংবাদিকরা ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে মত প্রকাশ করলেই বিভিন্নভাবে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন। এই আইনে এমন কিছু ধারা রয়েছে, যা সাংবাদিকদের স্বাভাবিক কাজ করতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, যেমন “মিথ্যা তথ্য প্রচার” বা “অসত্য তথ্য” প্রচারের অভিযোগে আটক করা।
সাংবাদিকরা যদি তাঁদের মতামত বা খবর প্রকাশ করার ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, তবে তা জনগণের অধিকার হরণ করার সমতুল্য। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি শক্তিশালী আইনগত ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে হুমকি ও আক্রমণ প্রতিরোধে এক শক্তিশালী আইন তৈরি করা উচিত।
বিশ্লেষকরা আরও মনে করেন, গণমাধ্যমে স্বাধীনতার সুরক্ষা করতে হলে রাষ্ট্রকে সাংবাদিকদের স্বাধীনতার প্রতি আস্থা রাখতে হবে এবং তাদের নিরাপত্তার জন্য আইনগত ব্যবস্থা আরও কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। বিশ্বে বেশ কয়েকটি দেশের সরকার এমন পদক্ষেপ নিয়েছে, যেখানে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা প্রদান এবং তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে আইনপ্রণয়ন করা হয়েছে।
সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা যে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, তা শুধু তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়, বরং এটি দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও মানবাধিকার সংকটে পড়ার উপক্রম। তাছাড়া, এ ধরনের পরিস্থিতি দেশের জন্য এক বিপজ্জনক প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা, জনগণের অধিকার এবং বিশ্বের কাছে দেশের প্রতিচ্ছবি নষ্ট করছে।
অতএব, রাষ্ট্রকে এখনই সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা পায় এবং দেশের গণতন্ত্র সুদৃঢ় হয়।