সিয়েরা লিওন,আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলির মধ্যে একটি। দেশটির মানুষগুলি দরিদ্র হলেও দেশটি দরিদ্র নয় কোনমতেই। কারন সিয়েরা লিওনের মাটিতে রয়েছে হীরার বিরাট ভান্ডার। তাই অনেক দেশের ই নজর এই দেশটির বিরাট হীরার ভান্ডারের ওপর। আর তাতে ক্ষেত্রবিশেষে জড়িয়ে পড়ে এই দেশটিতে শান্তি আনার নামে যাওয়া বিদেশী সৈন্যরাও।
নব্বই দশকের শেষ দিকে,সিয়েরা লিওনে হীরা পাচার আশংকাজনক হারে বেড়ে যায়। কারন এই হীরা পাচারের বিরাট র্যাকেটের সাথে যুক্ত ছিলো সেখানে শান্তিরক্ষী হিসেবে থাকা ভারতীয় ও নাইজেরীয় সৈন্যরা,আর তাতেই ব্যাপক ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে স্থানীয় মানুষ ও সিয়েরা লিওনের মিলিশিয়া গোষ্ঠী RUF (Revolutionary United Front)। ভারতীয় ফোর্স কমান্ডার বিজয় জেটলি নিজেই এই ডায়মন্ড স্মাগলিং র্যাকেটের সাথে যুক্ত ছিলেন বলে জানা যায়। তার অধীনস্থ ইউনিট গুলো সরাসরি ই এতে অংশ নিতো। ভারতে রয়েছে বিশ্বের ২য় বৃহৎ ডায়মন্ড কাটিং ইন্ড্রাস্ট্রি। এমনকি ভারত হতে সিভিলিয়ান ব্যবসায়ীরা ভারত হতে এসব শান্তিরক্ষী ইউনিট এর ছত্রছায়ায় ডায়মন্ড কালেকশন করত ও ভারতে পাচার করে নিয়ে আসতো। এর ফলে কার্যত ইউএন এর শান্তিরক্ষী ইউনিট গুলো সিয়েরা লিওনে তাদের গ্রহনযোগ্যতা হারাতে থাকে ও স্থানীয় জনতার সমর্থন না পাওয়ায় সিয়েরা লিওনের পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপ হতেই থাকে।
আর পরিপ্রেক্ষিতেই RUF নাইজেরিয়া ও ভারতের সৈন্যদের ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে অনেক সৈন্য হত্যা করেছে ও বহু সৈন্য জিম্মি করে। পুরো একটি ভারতীয় ক্যাম্প RUF মিলিশিয়াদের কাছে সারেন্ডার করায় বিদ্রোহীরা তাদের কেবল অন্তর্বাস ছাড়া বাকি সব ইউনিফর্ম, অস্ত্র, গোলাবারুদ হস্তগত করে অফিসার সহ সকলকে আন্ডারওয়ার পড়িয়ে রাখা হয় যা সিয়েরা লিওনের স্থানীয় একটি পত্রিকায় প্রকাশিত ও হয়েছিলো। RUF এর বিরুদ্ধে ভারত,ব্রিটেন সহ অনেক গুলি দেশ একত্রিত হয়ে “অপারেশন কুকরি” নামে একটি অপারেশন পরিচালনা করে ও কিছু সফলতাও পায়। ইন্ডিয়ান মিডিয়ায় ইন্ডিয়ান আর্মিকে হাইলাইট করা হলেও সিয়েরা লিওনে কর্মরত এমন কয়েকজন শান্তিরক্ষী ওই অপারেশনের যতটুকুই সফলতা তাতে ব্রিটিশ SAS ( যাদের বর্তমান বিশ্বের সেরা স্পেশাল ফোর্স গন্য করা হয় ) কেই অধিক ক্রেডিট দিয়েছেন। অপারেশন কুকরির পরেও সিয়েরা লিওনের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। বরং পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে উঠে ভারতীয় ফোর্স কমান্ডার বিজয় জেটলি এর উপর হীরা পাচারের আরোপ উঠে ও জাতিসংঘ তা তদন্তে নামে।
জাতিসংঘের তদন্তে ভারতীয় কমান্ডার বিজয় জেটলির হীরা পাচারে সংশ্লিষ্টতার প্রমান পাওয়া যায় ও বিজয় জেটলি কে বহিষ্কার করা হয়। এই লজ্জায় ও অভিমানে সিয়েরা লিওন হতে ভারত তাদের সকল সৈন্য সরিয়ে নেয়। ভারতের এই হঠাৎ সৈন্য সরিয়ে নেওয়ার ঘটনায় নাইজেরিয়ার সেনাপ্রধান ভারতীয় বাহিনীকে কাপুরুষ ও জেটলিকে একজন অযোগ্য লিডার হিসেবে তিরস্কার করেছিলেন। এত উচ্চপর্যায়ে এ ধরনের তিরস্কার খুবই কম ঘটে।
ভারত তাদের সকল সৈন্য সরিয়ে নিলে জাতিসংঘ কর্তৃক সেই স্থান নেওয়ার জন্য বাংলাদেশী ফোর্স তলব করা হয় ও সিয়েরা লিওনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী মিশন শুরু হয়।
নাইজেরীয় ফোর্স কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল উপান্ডে ও বাংলাদেশী কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হাসান সিয়েরা লিওনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী RUF এর সাথে শান্তিচুক্তি করে সিয়েরা লিওনের পরিবেশ শান্ত করতে সক্ষম হন ও সিয়েরা লিওনে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ন ইলেকশনের মাধ্যমে সিয়েরা লিওন স্থিতিশীল হতে থাকে। বাংলাদেশী ব্যাটালিয়ন দ্বারা ভারতীয় সৈন্যদের রিপ্লেস করার পর হতে সিয়েরা লিওনে হীরা পাচার এর হার ও অনেক কমে যায় ও ইউএন মিশনের সৈন্যদের সংশ্লিষ্টতা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায় বিধায় ইউএন এর গ্রহনযোগ্যতা বৃদ্ধি পায় সিয়েরা লিওনের অধিবাসীদের মাঝে। শুধু তাই নয়,বাংলাদেশী সেনারা সিয়েরা লিওনের মানুষদের আপন করে নেয় যার আর বাংলাদেশী সেনাদের সাহচর্যে সিয়েরা লিওনের জনগন খুব দ্রুতই বাংলা ভাষাও আয়ত্ব করে নেয়। অবশেষে বাংলাদেশী সেনাদের বদৌলতে ২০০২ সালে সিয়েরা লিওনের গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল শান্তিরক্ষা মিশনের একটি হলো সিয়েরা লিওন যে দেশে একই দায়িত্ব পালনে ভারতীয় ফোর্স চরমভাবে ব্যার্থ হয়েছিল।
উল্লেখ্য যে,সিয়েরা লিওনে বাংলাদেশী সেনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ২০০২ সালে সিয়েরা লিওনের প্রেসিডেন্ট আহমেদ তেজান কাব্বাহ বাংলা ভাষাকে সিয়েরা লিওনের ২য় রাস্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। পৃথিবীর ইতিহাসে হাজার মাইল দূরের দেশে এরকম ভাবে ভাষার স্বীকৃতির উদাহরন আর নেই।
তথ্যসূত্র :-The Guardian NewspaperBBC News