সম্পাদক: মুহাম্মদ জাকির হোসাইন
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত ও সংবেদনশীল প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি হলো: শেখ হাসিনা কি আসলে গণহত্যাকারী? এটি এমন একটি বিষয়, যা শুধু দেশের ভেতরেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন, subsequent repression এবং ২০২৫ সালে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের রায় — এই সব ঘটনা এই প্রশ্নকে আরও জটিল ও বিতর্কিত করেছে। আমরা এই বিষয়টি আইনগত, নৈতিক এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব।
২০২৪ সালের জুলাই থেকে আগস্টের মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রনেতৃত্বাধীন বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু হয়। মূলত কোটা পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে এই আন্দোলন শুরু হলেও, ধীরে ধীরে এটি দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ওঠে। আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ, এবং রাজনৈতিক দলের সক্রিয়তা এক ধরনের সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। অভিযোগ অনুসারে, এই দমন অভিযানটি একটি সুসংগঠিত, পরিকল্পিত এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বাধীন উদ্যোগ ছিল।
২০২৫ সালে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, ট্রাইব্যুনাল অভিযোগে উল্লেখ করেছে যে হত্যাযজ্ঞের সময় সরকারী নিরাপত্তা বাহিনী ও রাজনৈতিক সংস্থা একত্রিতভাবে কাজ করেছে। ট্রাইব্যুনাল রায় দেয় যে শেখ হাসিনা “mastermind, conductor and superior commander” ছিলেন। অর্থাৎ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা, নির্দেশনা এবং সমন্বয় করার ক্ষেত্রে তার নেতৃত্ব মূল ভূমিকা পালন করেছে। তবে, এখানেই প্রথম বিতর্ক জন্ম নেয়। অনেক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা যেমন Human Rights Watch জানিয়েছে যে, অভিযুক্তদের আদালতে উপস্থিত না রেখে বা trial in absentia–তে রায় প্রদান করা ন্যায্য বিচার প্রক্রিয়ার জন্য প্রশ্নবিদ্ধ। এটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যথেষ্ট সমালোচনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আইনগত দিক থেকে গণহত্যা (genocide) সংজ্ঞা নির্দিষ্ট। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী, গণহত্যা হলো কোনো বিশেষ জাতি, ধর্ম, জাত‑গোষ্ঠী বা সংজ্ঞায়িত গ্রুপকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এটি সাধারণ হত্যাকাণ্ড বা “crimes against humanity” থেকে আলাদা। তাই, ২০২৪–২০২৫ সালের ঘটনাকে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করতে হলে প্রমাণ থাকতে হবে যে, হত্যা বা repression নির্দিষ্ট “protected group”কে লক্ষ্য করে হয়েছে। এই প্রসঙ্গে দেখা যায় যে, হত্যাকাণ্ডের শিকাররা মূলত রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্র ও সাধারণ নাগরিক ছিলেন। তারা protected group হিসেবে আন্তর্জাতিক সংজ্ঞার আওতায় পড়ে না। ফলে আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে গণহত্যা বলাটা জটিল।
তবে, অন্য দিক থেকে দেখলে, এই হত্যাযজ্ঞকে mass atrocity বা state-sponsored mass killing হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ট্রাইব্যুনালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হত্যাযজ্ঞ পরিকল্পিত ছিল, উচ্চ নেতৃত্বের নির্দেশনায় সম্পন্ন করা হয়েছিল, এবং এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। হত্যাকাণ্ডের সময় নিরাপদ নাগরিক, শিক্ষার্থী এবং বিক্ষোভকারী – যারা সরকারের বিপক্ষে ছিলেন – তাদের উপর নির্যাতন, হত্যা এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘন চালানো হয়েছিল। এই বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুতর।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে শক্তিশালী রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বন্দ্ব এবং সামাজিক বিভাজনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। রাজনৈতিক বিরোধীতা প্রায়শই রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়ে রূপ নেয়। শেখ হাসিনার সমালোচকরা যুক্তি দেন যে, এই হত্যাযজ্ঞ ছিল সরকারী পদক্ষেপ, যা রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছিল। সমর্থকরা দাবি করেন, আন্দোলনটি রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা ভঙ্গ করার চেষ্টা ছিল এবং সরকারের পদক্ষেপ ছিল প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ। এভাবে বিষয়টি শুধু আইনগত নয়, রাজনৈতিক ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও জটিল।
যদি আমরা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও ন্যায্য বিচার প্রক্রিয়ার দিক থেকে বিচার করি, তাহলে দেখা যায় কিছু সমস্যা রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল রায় দেওয়ার সময় অভিযুক্তরা আদালতে উপস্থিত ছিলেন না। এছাড়া স্বচ্ছতা, প্রমাণ সংগ্রহ, সাক্ষ্য ও প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা প্রশ্ন তুলেছেন। trial in absentia এবং মৃত্যুদণ্ডের সংমিশ্রণ ন্যায্য বিচার ও মানবাধিকারের দিক থেকে সমস্যা সৃষ্টি করে। এগুলো বিচার প্রক্রিয়ার বৈধতা ও স্থায়িত্বের ওপর প্রশ্ন তোলে।
যেখানে রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞ এবং mass atrocity–এর প্রমাণ স্পষ্ট, সেখানে নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, এই ধরনের হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্র এবং উচ্চ নেতৃত্ব দায়ী। যে সরকার সাধারণ জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, নিরাপত্তা বাহিনীকে মানুষের ওপর প্রয়োগ করে এবং পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের নেতৃত্ব দেয়, সেই সরকারকে নৈতিকভাবে দায়ী হিসেবে গণ্য করা যায়। এই নৈতিক দায় আইনগত গণহত্যার সংজ্ঞার বাইরে হলেও, সামাজিক ও ঐতিহাসিক ন্যায্যতার দিক থেকে অপরিহার্য।
ইতিহাস ও সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। হত্যাযজ্ঞের সময় অসংখ্য পরিবার তাদের সন্তান হারিয়েছে। সমাজে ভীতি ও অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। ন্যায়বিচার, ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ছাড়া সমাজ ও রাষ্ট্র আগামীর জন্য সুরক্ষা দিতে পারে না। ইতিহাসও দেখিয়েছে যে, যে অপরাধ অস্বীকার করা হয়, তার পুনরাবৃত্তি হয়। অতএব, অপরাধীকে সনাক্ত করা, বিচার করা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায় প্রদান অপরিহার্য।
বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আইনগতভাবে গণহত্যাকারী হিসেবে শেখ হাসিনাকে অভিহিত করা কঠিন। কারণ আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী, protected group–এর উপর নির্দিষ্ট হত্যাযজ্ঞ না হলে, গণহত্যার পরিভাষায় এটি পড়বে না। কিন্তু mass atrocity, crimes against humanity বা state-sponsored political killing হিসেবে এই রায়, নৈতিক এবং আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে যথাযথ। এগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, সাংবাদিক, এবং বিচার বিশ্লেষকরা স্বীকার করেছেন।
ফলস্বরূপ, ইতিহাস ও ন্যায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে অপরাধীকে চিহ্নিত করা এবং দণ্ড প্রদান করা অত্যাবশ্যক। এটি শুধু অতীতের ক্ষত সারাবে না, ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক দমন প্রতিরোধে সাহায্য করবে। বাংলাদেশ যদি সত্যিকার অর্থে পুনর্বাসন, ন্যায়বিচার এবং সামাজিক শান্তি চায়, তাহলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রমাণিত অভিযোগ এবং ট্রাইব্যুনালের রায়ের ভিত্তিতে ন্যায় নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
সংক্ষেপে, শেখ হাসিনাকে আইনগতভাবে “গণহত্যাকারী” বলা কঠিন, তবে তার নেতৃত্বে পরিচালিত mass atrocity বা state-sponsored political repression–এর দায় শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে থাকা স্বাভাবিক। ন্যায়, ইতিহাস এবং সামাজিক শান্তির জন্য এই দায় স্বীকার এবং প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা অপরিহার্য। বিচার ও পুনর্বাসন ছাড়া বাংলাদেশের সমাজে স্থায়ী শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা কঠিন। তাই এই বিতর্ক শুধু বর্তমান রাজনীতি নয়, ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক ও নৈতিক কাঠামোর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।