আমাদের জীবন থেকে একটি বছর বিদায় নিয়ে শুরু হচ্ছে নতুন আরেকটি বছর। একটি বছরের বিদায় এবং আরেকটি নতুন বছরের প্রভাতবেলায় দাঁড়িয়ে একজন মুমিনের ভাবনা-পরিকল্পনা নতুন বিন্যাসে সাজানো প্রয়োজন। অতীতের যে সময়টুকু আল্লাহ তায়ালার মর্জি মোতাবেক কাটানোর সুযোগ হয়েছে, এর জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা, আর যে সময়গুলো অলস-অবহেলায় আল্লাহর অবাধ্যতায় নষ্ট হয়েছে, এর জন্য অনুশোচনা করা মুমিনের করণীয়। তবে মুমিনের আত্মপর্যালোচনা বর্ষকেন্দ্রিক বা সময়কেন্দ্রিক হওয়া উচিত নয়। বরং মুমিন প্রতিদিন তার আমলের হিসাব নেয় এবং গতকালের চেয়ে আগামীকালকে বেশি উপকারী ও ফলপ্রসূ করার চেষ্টা করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সব মানুষ প্রভাতে উপনীত হয় এবং নিজের সত্তাকে বিক্রি করে। আল্লাহর কাছে বিক্রি হয়ে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে, নতুবা শয়তানের কাছে বিক্রি হয়ে নিজেকে ধ্বংস করে’ (মুসলিম : ৩/১০০)।
পবিত্র কুরআনের অনেক জায়গায় আল্লাহ তায়ালা সময়ের বিভিন্ন অংশের শপথ করেছেন। যেমন রাত, দিন, ফজর, আসর ও পূর্বাহ্ন ইত্যাদি। আজ আমরা আমাদের জীবন থেকে একটি পরিপূর্ণ বছর বিদায় দিচ্ছি, যাতে আমরা আমাদের আমলসমূহ সংরক্ষণ করেছি, যা হাশরের দিন আমাদের আমলে তুলে ধরা হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনি দিন ও রাতকে পরিবর্তন করেন, নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানবানদের জন্য শিক্ষা রয়েছে।’ (সুরা নূর : আয়াত ৪৮)
একজন মুসলিম হিসেবে গত এক বছর আমার কী করার ছিল, কী করেছি; কতটুকু আমল করার দায়িত্ব ছিল, কতটুকু করতে পেরেছে ইত্যাদি হিসাব মেলাতে হবে জীবনের ডায়েরি খুলে। ফেলে আসা জীবনের ডায়েরিতে ধরা পড়বে অসংখ্য ভুল।
প্রভুর দরবারে সেসব ভুলের ক্ষমা প্রার্থনা করা বর্ষবিদায়ের প্রথম কাজ। হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের আত্মার হিসাব নাও নিজেদের হিসাব দেওয়ার আগে, তাকে ওজন করো নিজেদের ওজন দেওয়ার আগে…’ (তিরমিজি : ২৪৫৯)। বিদায়ি বছর কী কী ব্যর্থতা ছিল, নতুন বছরে এসব ব্যর্থতা কীভাবে দূর করা যাবে, নতুন বছর ব্যক্তি, সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য কী করতে পারি, প্রতিটি সময় সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারব কি না, একজন মুসলিম ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে কী দাবি রাখে, এসব নিয়ে পরিকল্পনায় বসা দ্বিতীয় কাজ। যদিও মুমিনের আত্মপর্যালোচনা কেবল বর্ষকেন্দ্রিক বা সময়কেন্দ্রিক হওয়া উচিত নয়। বরং মুমিন প্রতিদিন তার আমলের হিসাব নেয় এবং গতকালের চেয়ে আগামীকালকে বেশি উপকারী ও ফলপ্রসূ করার চেষ্টা করে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সব মানুষ প্রভাতে উপনীত হয় এবং নিজের সত্তাকে বিক্রি করে। আল্লাহর কাছে বিক্রি হয়ে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে, নতুবা শয়তানের কাছে বিক্রি হয়ে নিজেকে ধ্বংস করে।’ (মুসলিম : ৩/১০০)
ঈমানদার-মুসলিমের প্রথম পরিকল্পনা হওয়া চাই ‘আমল’ বিষয়ে। জানুয়ারির প্রথম দিন থেকে আমার নামাজ, রোজাসহ ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলো কীভাবে পালন করব, দৈনন্দিন কতটুকু কুরআন তেলাওয়াত করতে পারি, নফল নামাজ কয় রাকাত পড়তে পারি, নফল রোজা কয়টা রাখতে পারি, পরোপকার কীভাবে করতে পারি, দান-সদকা কীভাবে বাড়াতে পারি ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক পরিকল্পনা করা। একই সঙ্গে নিজে বদঅভ্যাসগুলো ছাড়ার পরিকল্পনাও করা চাই।
মিথ্যা বলা, গিবত করা, অন্যের ক্ষতি করা, দুর্নীতি করা ইত্যাদি থেকেও যেন আগামী এক বছর বেছে থাকতে পারিÑসে অনুযায়ী ভাবনা স্থির করা। সর্বোপরি চিন্তা করা, এই বছর যেমনই কেটেছে আগামী বছর যেন আমার আমলের খাতা নেকের দ্বারা আরও উজ্জ্বল হয়, আরও সমৃদ্ধ হয়। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন সময়ের যথাযথ গুরুত্ব ও মূল্যায়ন করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! আল্লাহকে ভয় করো, আগামী দিনের জন্য মানুষ কী পেশ করেছে, সে যেন তা দেখে নেয়। আর আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমরা যা করছ সে সম্পর্কে সম্যক অবগত।’ (সুরা হাশর : আয়াত ১৮)
ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর সময় খুবই অল্প। দেখতে দেখতে চলে যায় দিন। এ অল্প সময়ের মধ্যেই অনেক কিছু প্রস্তুত করতে হবে। জোগাড় করতে হবে পরকালের পাথেয়। পৃথিবী হচ্ছে পরকালের শস্যক্ষেত। পরকালের ফসল ফলার জন্যই মহান প্রভু আমাদের পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। যেদিন পৃথিবীতে পরকালের ফসল ফলানো যাবে না, সেদিন পৃথিবীরও কোনো মূল্য থাকবে না। অতএব দুদিনের দুনিয়ার চাকচিক্যের পেছনে না পড়ে, আমাদের মনোযোগী হতে হবে পরকালের ফসল ফলানোর কাজে।
দুনিয়াতে যা কিছু ফলাব, পরকালে তাই আমার সম্বল হবে। অনন্তকালের সঙ্গী হবে। ইংরেজি বর্ষ উদযাপনের নামে আমাদের সমাজে অশালীন ও আপত্তিকর কিছু চিত্র সামনে আসে। মুসলিম সমাজে এমনটা আদৌ কাম্য নয়। এ থেকে বিরত থাকতে হবে। নিজের ধর্ম এবং সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় এমন কিছু করা যাবে না নববর্ষ উদযাপনের নাম করে। এ জন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে আমাদের অভিভাবক ও সরকারের দায়িত্বশীলরা যেন চোখ-কান খোলা রাখেন নতুন বছরের প্রথম রাতে। নববর্ষে আমাদের জীবন কল্যাণের প্রাচুর্যে ভরে উঠুক। শান্তিময় হয়ে উঠুক দেশ ও জাতি। মহান আল্লাহর রহমতে পূর্ণ হোক জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত।