নিজস্ব প্রতিবেদক
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া কাপল ভিডিওর প্রভাব সমাজে এক ধরনের নেতিবাচক সাড়া ফেলেছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এ ধরনের ভিডিও কনটেন্ট ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ায় পারিবারিক মূল্যবোধে দেখা দিয়েছে বিপর্যয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব ভিডিওর কারণে পারস্পরিক অবিশ্বাস, দাম্পত্য কলহ এমনকি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনাও আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছে সমাজবিজ্ঞানীরা।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বেশ কিছু পরিবারে স্বামী বা স্ত্রী একে অপরের মোবাইল ফোনে এই ধরনের ভিডিও দেখে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। অনেক সময় এটি গৃহস্থালি জীবনে সন্দেহ, অভিমান এবং তিক্ততার সূত্রপাত ঘটায়। এ পরিস্থিতিকে ‘ডিজিটাল বিভ্রান্তি’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকার পারিবারিক আদালতের এক কর্মকর্তা জানান, “গত ছয় মাসে যে সংখ্যক বিবাহবিচ্ছেদের মামলা দায়ের হয়েছে, তার এক বড় অংশের পেছনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেতিবাচক ব্যবহার দায়ী।”
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. রেজওয়ান কবির বলেন, “এ ধরনের ভিডিও অনেক সময় বাস্তব জীবনের সঙ্গে মানুষের অনাকাঙ্ক্ষিত তুলনা সৃষ্টি করে। ফলে নিজের সম্পর্ক বা জীবনসঙ্গীর প্রতি অযৌক্তিক প্রত্যাশা তৈরি হয়, যা সম্পর্ক ভাঙনের পথে নিয়ে যেতে পারে।”
এই সমস্যা থেকে উত্তরণে পারিবারিক সংলাপ, ডিজিটাল মিডিয়ার সচেতন ব্যবহার এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কনটেন্টে নিয়ন্ত্রণ আনার ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, অনেক অভিভাবক উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, অপ্রাপ্তবয়স্করাও এখন এসব ভিডিওর দর্শক হয়ে উঠছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মূল্যবোধে গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে।
সরকারি পর্যায়ে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না থাকলেও সাইবার অপরাধ দমন ইউনিট জানিয়েছে, “অনৈতিক বা সামাজিকভাবে বিভ্রান্তিকর কনটেন্টের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সমাজের সচেতন মহলের দাবি, ব্যক্তিগত সম্পর্কের গোপনীয়তা রক্ষা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এখনই প্রয়োজন সম্মিলিত পদক্ষেপ।
কাপল ভিডিও বা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত অতিমাত্রায় রোমান্টিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্কভিত্তিক কনটেন্টের কারণে সংসারে বেশ কয়েকটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। নিচে সেগুলোর গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক তুলে ধরা হলো:
সংসারে কাপল ভিডিওর নেতিবাচক প্রভাব:
বিশেষজ্ঞদের মতামত:
১. ডা. রেজওয়ান কবির
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
“এই ধরনের ভিডিও দেখে অনেকেই নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে অনিশ্চয়তা ও হীনমন্যতায় ভোগে। এটা এক ধরনের ডিজিটাল প্রলাপ যা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ফলে একসময় মানসিক টানাপোড়েন তৈরি হয়, যা সম্পর্ক ভাঙার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।”
২. প্রফেসর সাবিহা আনোয়ার
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
“সোশ্যাল মিডিয়ার কৃত্রিম রোমান্স সমাজে সম্পর্কের বিকৃত ধারণা ছড়িয়ে দিচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম মনে করছে, সম্পর্ক মানেই সব সময় আনন্দ, ঘুরে বেড়ানো, উপহার দেওয়া। বাস্তব জীবনের সংগ্রাম ও বোঝাপড়ার জায়গাটা উপেক্ষিত হচ্ছে।”
৩. মো. কামরুল হাসান
সিনিয়র ম্যাজিস্ট্রেট, পারিবারিক আদালত
“আমাদের কোর্টে বিবাহবিচ্ছেদের যে পরিমাণ মামলা আসছে, তার একটা বড় অংশই সোশ্যাল মিডিয়া কেন্দ্রিক ঝামেলা থেকে শুরু হচ্ছে। কেউ কারো ইনবক্স, ফলো করা কনটেন্ট, বা দেখা ভিডিও নিয়ে ঝগড়া করছে।”
৪. সাইবার বিশেষজ্ঞ তানভীর ইকবাল
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (BTRC)
“অনেক সময় কাপল ভিডিওগুলো ভুয়া বা স্ক্রিপ্টেড হয়। কিন্তু দর্শক সেটাকে বাস্তব ভেবে নিজের জীবনের সঙ্গে তুলনা করে ফেলেন। এ থেকে সমাজে মনস্তাত্ত্বিক চাপ ও অবিশ্বাস ছড়ায়। তাই কনটেন্ট মডারেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
৫. রাবেয়া জাহান
পারিবারিক পরামর্শক ও থেরাপিস্ট
“অনেক দম্পতি আমার কাছে এসে বলেন, স্ত্রী বা স্বামী ভিডিও দেখে বলে, ‘দেখো ওরা কত রোমান্টিক’, ‘তুমি এমন করো না কেন’। এসব তুলনা সম্পর্কের স্বাভাবিক গতিকে ধ্বংস করে দেয়।”
এইসব মতামত প্রমাণ করে যে, কাপল ভিডিওর মতো কনটেন্ট যদি যাচাই-বাছাইহীনভাবে দেখা ও বিশ্বাস করা হয়, তাহলে তা দাম্পত্য সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।