সম্পাদক : মুহাম্মদ জাকির হোসাইন
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এক সময় ছিল অন্যতম প্রধান শক্তি। অথচ আজ সেই দলটি ক্রমেই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন, দিশাহীন এবং আত্মস্ববিরোধিতায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অভিযোগ ও দাবি উপস্থাপন করলেও নিজেদের নীতি, রূপরেখা ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে যে দুর্বলতা ও দ্বন্দ্ব প্রকটভাবে প্রকাশ পাচ্ছে, তা দলটির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে যে উদ্বেগ বিএনপি প্রকাশ করেছে, তাতে বাস্তব পরিস্থিতির কিছু সত্য হয়তো উঠে এসেছে, কিন্তু প্রশ্ন হলো—এক দশকের বেশি সময় ধরে নির্বাচন বর্জন, আন্দোলনের নামে সহিংসতা, এবং বিদেশ নির্ভর কূটনৈতিক প্রচারণার ব্যর্থ কৌশলই কি আজকের এ সংকটের জন্য মূলত দায়ী নয়?
বিএনপি বারবার বলে আসছে তারা একটি “গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল”। অথচ দলটির অভ্যন্তরীণ গঠনে গণতন্ত্রের চর্চা নেই বললেই চলে। নেতৃত্বের প্রশ্নে পরিবারকেন্দ্রিকতা, সিনিয়র নেতাদের মত উপেক্ষা, এবং নীতিগত সিদ্ধান্তে অস্থিরতা বারবার প্রমাণ করে বিএনপির রাজনীতি এখন অনেকাংশেই প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রতিহিংসা নির্ভর হয়ে উঠেছে।
দলটি একদিকে সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক রোডম্যাপ দাবি করছে, অন্যদিকে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে রাজপথে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার পতনের স্বপ্ন দেখে চলেছে। গণআন্দোলনের নামে বারবার সহিংসতা ও সাধারণ মানুষের ভোগান্তি তৈরি করে তারা আদতে নিজেদের গণবিচ্ছিন্নতাকেই আরো ঘনীভূত করছে। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দায়িত্বশীল বিরোধী দলের যে ভূমিকা প্রত্যাশিত, তা পালন করতে বিএনপি বারবার ব্যর্থ হয়েছে।
অন্যদিকে, বিএনপির নীতি ও অবস্থানেও পরস্পরবিরোধিতা চোখে পড়ে। একদিকে দলটি সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মহলে ‘গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা’ সেজে সহানুভূতি কুড়াতে চায়। এই দ্বিমুখী রাজনীতি দলের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করেছে।
বিশেষ করে দেশের উন্নয়ন, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি বা পরিবেশ নিয়ে বিএনপির কোনো স্পষ্ট রূপরেখা নেই। তাদের রাজনীতি কেবল সরকারের বিরোধিতা আর পদত্যাগ দাবি—যা আধুনিক ও কার্যকর গণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির উচিত ছিল জনগণের সামনে একটি বিকল্প উন্নয়নমুখী নীতি ও পথনকশা উপস্থাপন করা, যা তারা করতে পারেনি।
আজকের বিশ্বে রাজনীতি কেবল বিরোধিতার নামে আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রয়োজন হয় জনগণের আস্থা অর্জন, ভিশন উপস্থাপন এবং দায়িত্বশীলতা দেখানো। বিএনপি যদি সত্যিই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তবে তাদের উচিত হবে নির্বাচনী রাজনীতিতে ফিরে আসা, সহনশীল রাজনৈতিক আচরণ শেখা, এবং আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে নিজেদের সংস্কার করা।
দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য স্বাভাবিক। কিন্তু সেই সময়টিকে আত্মজিজ্ঞাসা ও পুনর্গঠনের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ না করে, বারবার ব্যর্থ ও সহিংস কৌশলের পুনরাবৃত্তি দলটির অস্তিত্বকেই সংকটে ফেলছে।
আমরা আশা করি, বিএনপি অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে ভবিষ্যতে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে।
দেশের রাজনীতি যদি সুষ্ঠু পথে এগিয়ে যেতে চায়, তবে প্রয়োজন সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে দায়িত্ববোধ, গণতান্ত্রিক চর্চা এবং জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া। বিএনপির ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হওয়ার সুযোগ নেই।