1. desherchitrabd@gmail.com : Desher DesherChitra : Desher Chitra
সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ০৪:৪৫ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম :

গড়তে চাই দুর্নীতিমুক্ত ও বৈষম্যহীন এক নতুন বাংলাদেশ

  • আপডেট টাইম : বুধবার, ৪ জুন, ২০২৫

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশ আজ এক উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। বৈশ্বিক অর্থনীতি ও রাজনীতিতে আমরা এক দৃশ্যমান উপস্থাপন তৈরি করতে পেরেছি। পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, কৃষি ও প্রযুক্তিতে অগ্রগতি, নারীশিক্ষা ও স্বাস্থ্যে উন্নয়ন, রপ্তানিতে বৈচিত্র্য এবং সামগ্রিক দারিদ্র্য হ্রাস—এসবই আমাদের অর্জন। তবে একটি প্রশ্ন আমাদের সকল অর্জনের মাঝেও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে—এই অগ্রযাত্রা কি টেকসই? আমরা কি শুধুই অবকাঠামোগত অগ্রগতিকে উন্নয়ন বলবো, নাকি মানবিক মূল্যবোধ, ন্যায়বিচার ও সামাজিক সমতা নিশ্চিত করার পথেও এগোচ্ছি?

আমাদের স্বপ্ন, আমাদের আকাঙ্ক্ষা—একটি দুর্নীতিমুক্ত ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ। একটি রাষ্ট্র যেখানে একজন দিনমজুর ও একজন কর্পোরেট কর্মকর্তা উভয়েরই সমান সুযোগ থাকবে, যেখানে একটি দরিদ্র শিশু ও একটি ধনীর সন্তান এক সাথে সমান শিক্ষার আলো পাবে, যেখানে ন্যায্যতা, জবাবদিহিতা ও মানবিক মর্যাদা থাকবে সবার জন্য সমান। এই স্বপ্ন নিছক কোনো কল্পনা নয়, বরং এটি আমাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব ও নাগরিক অধিকারের বাস্তবায়ন।

দুর্নীতি একটি ক্যান্সারের মতো; এটি সমাজের প্রতিটি শিরায়-উপশিরায় বাসা বাঁধে এবং রাষ্ট্রকে ভেতর থেকে গিলে ফেলে। বাংলাদেশ দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে স্বাধীনতার পর থেকেই। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল প্রতি বছর যে দুর্নীতির সূচক প্রকাশ করে, সেখানে বাংলাদেশ বহু বছর ধরে নিন্ম স্তরে অবস্থান করছে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছুটা উন্নতি হয়েছে, কিন্তু এখনো প্রতিদিনের জীবনে দুর্নীতির উপস্থিতি স্পষ্ট।

দুর্নীতির সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের জীবনে। একজন গরিব কৃষক যদি জমির খাজনা দিতে গিয়ে ঘুষ দিতে বাধ্য হয়, একজন দরিদ্র রোগী যদি সরকারি হাসপাতালে সেবা পেতে অর্থ দিতে বাধ্য হয়, অথবা একজন তরুণ যদি চাকরি পেতে ঘুষ দিতে বাধ্য হয়—তাহলে সেই রাষ্ট্র প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক হতে পারে না।

বাংলাদেশে বৈষম্য একটি বহুমাত্রিক সমস্যা। এটি শুধু অর্থনৈতিক নয়; সামাজিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সুযোগের ক্ষেত্রেও স্পষ্ট। একদিকে রাজধানীর অভিজাত এলাকার একজন শিশুর জন্মের সময় থেকেই আধুনিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ইন্টারনেট সুবিধা, নিরাপত্তা এবং সামাজিক স্বীকৃতি মেলে। অন্যদিকে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন দরিদ্র পরিবারের শিশুর হয়তো জন্মই হয় বিনা চিকিৎসায়, বেড়ে ওঠে অপুষ্টি ও অনিশ্চয়তার মাঝে, স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয় না, হয়তো বাল্যবিবাহ অথবা শিশুশ্রমে নিযুক্ত হতে হয়।

বৈষম্য কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি লিঙ্গভিত্তিক, ধর্মভিত্তিক, নৃতাত্ত্বিক এবং শারীরিক প্রতিবন্ধিতার ভিত্তিতেও সমাজে বিদ্যমান। এ বৈষম্য যদি চলতেই থাকে, তবে একটি সমাজ যতই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করুক না কেন, প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়।

একটি বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রধান হাতিয়ার হলো শিক্ষা। তবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও বিভাজনের শিকার। একদিকে রয়েছে ইংরেজি মাধ্যমে উচ্চমূল্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অন্যদিকে জাতীয় পাঠ্যক্রম ভিত্তিক বিভিন্ন মানের স্কুল। আবার আছে মাদ্রাসা শিক্ষার আলাদা ধারা। এই বৈচিত্র্য যেমন সাংস্কৃতিকভাবে উপকারী হতে পারে, তেমনি মান ও সুযোগের ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করে।

অন্যদিকে, স্বাস্থ্যসেবা খাতেও একই চিত্র। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেখানে একজন MBBS ডাক্তার নিয়মিত থাকেন না, সেখানে শহরের বেসরকারি হাসপাতালে সেবা দিতে গিয়ে মানুষ সর্বস্বান্ত হয়। সরকারি সেবাগুলোর মানোন্নয়ন ও জবাবদিহিতা না থাকলে, নাগরিকরা বঞ্চিতই থেকে যাবে।

দুর্নীতি ও বৈষম্য প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা। আইন ও নীতিমালা যতই ভালো হোক না কেন, তা কার্যকর হয় না যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব তা প্রয়োগে আন্তরিক না হয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হলে, প্রশাসনিক এবং বিচারব্যবস্থার মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।

এছাড়া সংবিধানে প্রত্যয়িত মৌলিক অধিকারসমূহের বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। এক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কার্যকারিতা, স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন, এবং সাংবাদিক ও সিভিল সোসাইটির স্বাধীন ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রাষ্ট্র কেবল সরকারের দ্বারা গঠিত হয় না। নাগরিকরাও রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই এবং বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে প্রতিটি নাগরিকেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আমাদের প্রতিদিনের আচরণে সততা ও ন্যায়বোধ থাকতে হবে। কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে চুপ না থেকে প্রতিবাদ করা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তথ্যভিত্তিক সচেতনতা তৈরি, এবং তরুণ প্রজন্মকে মানবিক মূল্যবোধে গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে আমরা একটি উত্তম সমাজ নির্মাণে সহায়তা করতে পারি।

তরুণ সমাজকে নেতৃত্ব দিতে হবে। যারা প্রযুক্তি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে এগিয়ে আছে, তারা চাইলে অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারে, স্বচ্ছতা দাবি করতে পারে, এবং সমাজকে নৈতিক আদর্শে পরিচালিত করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘ইথিক্স ক্লাব’, স্কুল-কলেজে দুর্নীতিবিরোধী আলোচনা, এবং গণমাধ্যমে তদন্তমূলক প্রতিবেদন এই পথে কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে।

বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই কিছু আশাজাগানিয়া পরিবর্তনের চিত্র দেখা যাচ্ছে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ধারণা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারি সেবায় স্বচ্ছতা কিছুটা বেড়েছে। অনলাইনে পাসপোর্ট আবেদন, ভূমি রেকর্ড যাচাই, কর প্রদান ইত্যাদি সহজ হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির সুযোগ কমেছে। এছাড়া কিছু জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের উদ্ভাবনী উদ্যোগ নাগরিকদের আস্থা বাড়িয়েছে।

শিক্ষাক্ষেত্রে এনসিটিবির নতুন পাঠ্যক্রম এবং কারিগরি শিক্ষার প্রসার বৈষম্য কমাতে সহায়ক হতে পারে। তবে এসব উদ্যোগ কেবল সাময়িক নয়, টেকসই করার জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং নাগরিক সম্পৃক্ততা।

একটি দুর্নীতিমুক্ত ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ আমাদের স্বপ্ন—কিন্তু এটি বাস্তবায়নযোগ্য, যদি আমরা সকলে তা অর্জনে আন্তরিক হই। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রয়োজন—স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সরকার, কার্যকর প্রশাসন, প্রগতিশীল শিক্ষা ব্যবস্থা, বৈষম্যহীন স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা, শক্তিশালী গণমাধ্যম এবং সচেতন নাগরিক সমাজ।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর আমরা যদি এখনো এমন একটি বাংলাদেশ গড়তে না পারি, যেখানে মানুষ সমান মর্যাদা পায়, যেখানে উন্নয়ন সবার জন্য, সেখানে উন্নয়নের অর্জন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে একতাবদ্ধ হয়ে দুর্নীতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। আসুন, স্বপ্ন দেখি—একটি বাংলাদেশ, যেখানে শিশু বড় হয় সমতার আলোয়, যুবক গড়ে তোলে সততার ভিত্তি, এবং বৃদ্ধ পায় মর্যাদার আশ্রয়।

স্বপ্ন দেখি, একটি দুর্নীতিমুক্ত ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ—যা কেবল কল্পনা নয়, বরং একটি বাস্তব ভবিষ্যৎ।

Share this Post in Your Social Media

এই ধরনের আরও খবর
Copyright © 2025, সাপ্তাহিক দেশের চিত্র. All rights reserved.
Weekly Desher Chitra developed by LogoMyface