দেশের চিত্র ডেস্ক
বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিসর বরাবরই জটিল এবং বহুস্তরবিশিষ্ট। একদিকে দেশে জঙ্গি হামলার উল্লেখযোগ্য ইতিহাস আছে। যেমন ২০১৬ সালের গুলশান হোলি আর্টিজান বেকারিতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ হামলা। অন্যদিকে, সরকার ও পুলিশ কখনো প্রকাশ্যভাবে জানায় “দেশে এখন জঙ্গি নেই।” কিন্তু এই কথার সঙ্গে সাম্প্রতিক গ্রেপ্তার, জামিনে মুক্ত জঙ্গি, অনলাইনে উগ্রবাদ প্রচারের ধারা এবং বিদেশে গ্রেপ্তার হওয়া প্রবাসী নাগরিকদের ঘটনা প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশ জঙ্গি-হীন নয়, বরং দেশের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলো অনেক সূক্ষ্ম ও জটিল।
২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশান-২-এ হোলি আর্টিজান বেকারিতে এক হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়। ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ মোট ২০ জন নিহত হন, এবং দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন উদ্ধার অভিযান চালানোর সময়। হামলার দায় আন্তর্জাতিক উগ্রবাদী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) স্বীকার করলেও বাংলাদেশ সরকার তখন নব্য জেএমবি-কে দায়ী ঘোষণা করেছিল।
সেই ঘটনায় অভিযুক্ত ৭ জন জঙ্গিকে প্রথমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, পরে হাইকোর্ট তাদের সাজা আমৃত্যু কারাদণ্ডে রূপান্তরিত করে। একই সঙ্গে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও আরোপ করা হয়। বিচারিক আদালতের অন্যান্য ধারায় দেওয়া দণ্ড বহাল রাখা হয়েছে।
ঘটনাস্থলে নির্মিত ভাস্কর্য ‘দীপ্ত শপথ’ প্রতি বছর নিহত পুলিশ কর্মকর্তাদের স্মরণে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও শ্রদ্ধা জানার কেন্দ্র ছিল। তবে ২০২৫ সালে তা লক্ষ্য করা যায়নি, এবং হিজবুত তাহরীরের পোস্টার ও আনুষ্ঠানিকতা অনুষ্ঠিত হয়।
হোলি আর্টিজানের ৯ বছর পূর্তির দিনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী সাংবাদিকদের বলেন, “বাংলাদেশে জঙ্গি নাই, এখন ঠেকাতে হবে ছিনতাই।” তার বক্তব্যে সমালোচনার বিষয় হলো—তিনি দেশের জঙ্গি হুমকিকে স্বল্পমূল্যায়ন করছেন।
উল্টো দিকে, পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বলেন, “জঙ্গি নেই—এ কথা বলা যাবে না। তবে এই মুহূর্তে তাদের তৎপরতা বেশি নেই। যারা জামিনে মুক্ত হয়েছে, তারা নজরদারির মধ্যে রয়েছে।”
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. মাসুদ করিম বলেন, দেশে বর্তমানে বড় কোনো হামলার ঝুঁকি নেই, তবে অনলাইনে তৎপরতা রয়েছে এবং নজরদারি অব্যাহত আছে।
৫ আগস্ট সরকারের পরিবর্তনের পর দেশে বিভিন্ন কারাগার থেকে প্রায় ২,২০০ বন্দি পালিয়ে যায়। এর মধ্যে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত, শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং সাধারণ অপরাধীরা অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে ৭০০ জন এখনও পলাতক।
জেল এবং কারাগারের ধারণক্ষমতা দেশের নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ৫ আগস্টের আগে বন্দির সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০ হাজার। বর্তমানে এটি ৬৫ হাজারে উন্নীত হয়েছে। জামিনে মুক্ত হওয়া আসামিদের মধ্যে ১৭৪ জন জঙ্গি এবং ১১ জন শীর্ষ সন্ত্রাসী রয়েছেন।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় জঙ্গি নেটওয়ার্কে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৬ জন প্রবাসী বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা আইএস-এর মতাদর্শ প্রচার ও সদস্য সংগ্রহের সেল গঠন করেছিল। এর মধ্যে ২১ জনের বিচারের দায়িত্ব মালয়েশিয়া বহন করবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, “যদি দেশে জঙ্গি না থাকে, তাহলে এই গ্রেপ্তার কেন?” এটি প্রমাণ করে, বাংলাদেশি নাগরিকদের বিদেশেও জঙ্গি কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার ঘটনা ঘটছে।
হিজবুত তাহরীর বাংলাদেশে নিষিদ্ধ থাকলেও, তারা প্রকাশ্য ও গোপনে কার্যক্রম চালাচ্ছে। ২০২৫ সালের মার্চে ঢাকায় ‘মার্চ ফর খেলাফত’ সমাবেশে প্রায় ২,০০০ সমর্থক অংশগ্রহণ করে। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, “জঙ্গি নেই বলে আত্মতৃপ্তি ভুল। রাষ্ট্র থেকে যদি তাদের কথার প্রতিধ্বনি আসে, তারা বিপ্লবী হওয়ার দরকার মনে করবে না। জঙ্গিবাদ শুধু বাংলাদেশ সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক সমস্যা।”
৫ আগস্ট সরকারের পরিবর্তনের পর দেশের বিভিন্ন জেল থেকে ৫,৭৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়। এর মধ্যে ৪,৩৩১টি উদ্ধার হয়েছে, ১,৪১৯টি এখনও উদ্ধার হয়নি। লুট হওয়া গোলাবারুদের মধ্যে ২ লাখ ৬৩ হাজার ১৫৩টি এখনও উদ্ধার হয়নি।
এ তথ্য প্রমাণ করে, দেশের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ কেবল জঙ্গি উপস্থিতির কারণে নয়; অস্ত্র ও গোলাবারু ব্যবস্থাপনা, বন্দি নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আইইপি-র বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ সূচকে ২০২৫ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৫তম। দক্ষিণ এশিয়ায় সাতটি দেশের মধ্যে চতুর্থ। দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসবাদের দিক থেকে পাকিস্তান শীর্ষে, তারপরে আফগানিস্তান ও ভারত।
এ সূচক দেখাচ্ছে, বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদের বিস্তারে এখনো ঝুঁকিমুক্ত নয়। অনলাইনে উগ্রবাদ প্রচারের তৎপরতা এখনও বিদ্যমান।
গুম সংক্রান্ত কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম বলেন, “সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় রাষ্ট্রের সততা, মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতি এবং আইনসম্মত প্রক্রিয়ার অটল থাকা জরুরি।”
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, “জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই জামিনে মুক্ত বা বিভিন্নভাবে ছাড়া পেয়েছেন। নজরদারি শিথিল রাখা বিপজ্জনক।”
বাংলাদেশে জঙ্গি নেই,এই বক্তব্য পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দ্বারা প্রকাশিত হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। দেশ এখনও জঙ্গি-প্রবণ এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ। হোলি আর্টিজান হামলার স্মৃতি, হিজবুত তাহরীরের কার্যক্রম, লুট হওয়া অস্ত্র, বিদেশে গ্রেপ্তার এবং অনলাইনে উগ্রবাদ প্রচার সব মিলিয়ে নির্দেশ করছে যে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সতর্ক এবং সক্রিয় নজরদারি অব্যাহত রাখতে হবে।
সরকারি, নিরাপত্তা সংস্থা এবং মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা একসঙ্গে কাজ না করলে জঙ্গি-হুমকি পুনরায় বৃদ্ধি পেতে পারে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য কার্যকর, স্বচ্ছ এবং মানবিক নীতি গ্রহণ অপরিহার্য।
সূত্র : ডয়চে ভেলে