সম্পাদক: মুহাম্মদ জাকির হোসাইন
মানুষ সবসময় চায় শান্তি, নিরাপত্তা আর উন্নত জীবন। কিন্তু যখন সমাজে অন্যায়, দারিদ্র্য, বা শাসকদের অবিচার বেড়ে যায়, তখন অনেক সময় কিছু মানুষ রাগে বা হতাশায় অস্ত্র তুলে নেয়। তারা ভাবে, জোর করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা যায়। এই ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় জঙ্গিবাদ। কিন্তু ইতিহাস আমাদের বারবার দেখিয়েছে — জঙ্গিবাদ বা হিংসার মাধ্যমে কখনোই জনকল্যাণকর রাষ্ট্র গড়া যায় না। সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা এর ঘটনাই তার বড় উদাহরণ।
সিরিয়া একসময় সুন্দর ও সংস্কৃতিতে ভরপুর দেশ ছিল। কিন্তু গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশটি যুদ্ধ ও ধ্বংসের মধ্যে আছে। জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের দাবিতে। কিন্তু সেই আন্দোলন পরে গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। নানা সশস্ত্র গোষ্ঠী, বিদেশি শক্তি ও ধর্মীয় জঙ্গি সংগঠন একে একে সেখানে ঢুকে পড়ে। এদের কেউ কেউ দাবি করেছিল—তারা জনগণের জন্য লড়ছে, দেশের মঙ্গল চায়। কিন্তু বাস্তবে তারা দেশের শান্তি নষ্ট করেছে, লাখ লাখ মানুষকে উদ্বাস্তু করেছে।
এই বিশৃঙ্খলার মধ্য থেকেই উঠে আসেন আহমেদ আল-শারা। প্রথমে তিনি ছিলেন এক সশস্ত্র সংগঠনের নেতা। তিনি বলেছিলেন, দেশের মুক্তির জন্য লড়ছেন। কিন্তু পরে যুদ্ধের পর দেশের ক্ষমতা তাঁর হাতে আসে, এবং তিনি প্রেসিডেন্ট হন। তাঁর নেতৃত্বে কিছু শৃঙ্খলা ফিরলেও, জনগণের কষ্ট কমেনি, বরং অনেক জায়গায় ভয়, দমননীতি আর অনিশ্চয়তা বেড়েছে। এখানেই প্রমাণ পাওয়া যায়—অস্ত্রের শক্তিতে রাষ্ট্র গঠন সম্ভব হলেও, জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠন কখনোই সম্ভব নয়।
১. ভয় দিয়ে নয়, আস্থা দিয়ে রাষ্ট্র চলে
রাষ্ট্র মানে জনগণের অংশগ্রহণ। মানুষ যদি সরকারের ওপর আস্থা না পায়, তাহলে উন্নয়ন বা শান্তি টেকসই হয় না। জঙ্গিবাদের মাধ্যমে যে নেতৃত্ব আসে, তা সাধারণত ভয় বা শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। এমন নেতাদের মানুষ ভালোবাসে না, বরং ভয় পায়। ভয় থেকে সাময়িক শৃঙ্খলা আসতে পারে, কিন্তু স্থায়ী শান্তি আসে না।
২. জঙ্গিবাদের মূল ভাবনা হিংসা, আর হিংসা দিয়ে ভালো কিছু গড়া যায় না
হিংসা যতই ‘ন্যায়ের জন্য’ বলা হোক না কেন, সেটি শেষ পর্যন্ত ধ্বংসই আনে। জঙ্গিবাদ মানুষকে বিভক্ত করে, সমাজে অবিশ্বাস ছড়ায়, এবং শিক্ষিত, কর্মক্ষম মানুষ দেশ ছেড়ে চলে যায়। রাষ্ট্র তখন দুর্বল হয়ে পড়ে।
৩. প্রশাসন ও উন্নয়নের অভিজ্ঞতা থাকে না
জঙ্গিগোষ্ঠীগুলি যুদ্ধ করতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্র চালাতে জানে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, কৃষি—এসব ক্ষেত্র সামলাতে লাগে জ্ঞান, পরিকল্পনা ও সহযোগিতা। জঙ্গি নেতৃত্বের সেই কাঠামো সাধারণত থাকে না। ফলে ক্ষমতা পেলেও তারা সুশাসন দিতে পারে না।
৪. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পাওয়া যায় না
যে নেতা বা সরকার জঙ্গিবাদ থেকে উঠে আসে, তাকে অনেক দেশই বিশ্বাস করে না। ফলে তারা সাহায্য, বিনিয়োগ বা সহযোগিতা দিতে চায় না। এতে দেশ আরও বিচ্ছিন্ন হয়, অর্থনীতি ভেঙে পড়ে, সাধারণ মানুষ কষ্ট পায়।
আহমেদ আল-শারা হয়তো ভেবেছিলেন, অস্ত্রের মাধ্যমে অন্যায় সরকারকে সরিয়ে জনগণের জন্য ভালো কিছু করবেন। কিন্তু বাস্তবে তাঁর সরকারও নানা সমস্যায় জর্জরিত। মানুষ এখনও দারিদ্র্যের মধ্যে আছে, অনেক জায়গায় ভয়-ভীতি আছে, আর দেশ পুনর্গঠনের কাজ ধীরগতিতে চলছে। বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না, কারণ তাঁর অতীত জঙ্গিবাদে জড়িত ছিল। ফলে জনগণও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না।
এভাবে দেখা যায়, উদ্দেশ্য ভালো হলেও যদি পথ হয় ভুল, তাহলে ফলও ভালো হয় না। জঙ্গিবাদ বা হিংসার মাধ্যমে কেউ যতই ক্ষমতায় আসুক, তার শাসন জনগণের কল্যাণ বয়ে আনে না।
একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তার জনগণ। যখন মানুষ নিজের মতামত দিতে পারে, নিরাপদে থাকতে পারে, কাজ ও শিক্ষার সুযোগ পায়—তখনই সেই দেশ এগোয়। কিন্তু জঙ্গিবাদ এই সবকিছু ধ্বংস করে দেয়।
যে সমাজে হিংসা থাকে, সেখানে শিক্ষা থেমে যায়, ব্যবসা বন্ধ হয়, চিকিৎসা ব্যাহত হয়। শিশুরা ভয় পায়, নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, আর তরুণরা ভবিষ্যৎ হারায়। এই বাস্তবতা সিরিয়াসহ আরও অনেক দেশে দেখা গেছে।
রাষ্ট্র গঠনের আসল পথ হলো সংলাপ, গণতন্ত্র, ও ন্যায়বিচার।
অস্ত্রের বদলে যদি মানুষ কথা বলে সমস্যার সমাধান খোঁজে, তাহলে স্থায়ী শান্তি সম্ভব হয়। জঙ্গিবাদ সাময়িক প্রতিশোধ দিতে পারে, কিন্তু ভবিষ্যৎ গড়তে পারে না।
সিরিয়ার মতো দেশগুলোর জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি—শান্তির সংস্কৃতি তৈরি করা, নতুন প্রজন্মকে হিংসার বাইরে এনে শিক্ষিত ও মানবিক করে তোলা।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা আমাদের চোখে এক কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, অস্ত্র হাতে ক্ষমতা দখল করা সহজ, কিন্তু সেই ক্ষমতা দিয়ে জনগণের কল্যাণ করা অসম্ভব। জঙ্গিবাদে জন্ম নেওয়া সরকার জনগণের আস্থা হারায়, দেশকে আরও দুর্বল করে তোলে।
আজকের পৃথিবী আমাদের শেখায়—রাষ্ট্র গঠনের মূল শক্তি হলো মানুষ, শিক্ষা, ন্যায় ও শান্তি।
জঙ্গিবাদ নয়, সংলাপই উন্নতির পথ।
তাই আমরা যদি সত্যিই জনকল্যাণকর রাষ্ট্র চাই, তাহলে অস্ত্র নয়, মানবতার পথই বেছে নিতে হবে।