দেশের চিত্র প্রতিবেদন
সিলেটে আত্মহত্যার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের ও তরুণদের মধ্যে মানসিক চাপে থাকা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়াতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।
সিলেটে মাত্র এক বছরে কমপক্ষে ১২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে, এমন তথ্য পাওয়া গেছে স্থানীয় জরিপ ও সংবাদ রিপোর্ট থেকে। এই সংখ্যা জাতীয় পরিপ্রেক্ষিতে হলেও তা সহজে উপেক্ষা করার মতো নয়। অভিমান, প্রেমঘটিত সমস্যা এবং মানসিক অস্থিরতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর ও তরুণ শিক্ষার্থীদের আবেগ প্রবণতা, পারস্পরিক সম্পর্কের জটিলতা এবং পারিবারিক প্রত্যাশার চাপে তাদের মানসিক চাপ গাঢ় হতে পারে এবং অনেক সময় তারা আত্মহত্যাকে একমাত্র আশ্রয় হিসেবে দেখে ফেলে।
একটি একাডেমিক গবেষণাও নির্দেশ করছে যে, সিলেট অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার চেষ্টা করার ক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের ঝুঁকি আছে। গবেষণায় দেখা গেছে, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা, পারিবারিক অবক্ষয় এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তাদের আত্মহত্যার প্রবণতাকে ত্বরান্বিত করতে পারে। সার্ভেতে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই গ্রামীণ পটভূমির এবং ছোট-পরিবার থেকে এসেছে, যার ফলে তারা আবাসিক এবং মানসিক সহায়তায় সীমিত ছিল।
শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা ও রয়েছে। সম্প্রতি, সিলেটে দুইটি ‘রহস্যজনক আত্মহত্যা’ ঘটেছে। প্রথমটি হলো একটি রিকশা চালকের মীরাবাজার এলাকায় মনসুর (৩০) নামক ওই ব্যক্তি পারিবারিক সমস্যার কারণে নিজদেহে পেট্রোল ঢেলে আত্মহত্যা করেছেন বলে পুলিশ ধারণা করছে।
দ্বিতীয় ঘটনা আরও হৃদয়বিদারক: শাহপরাণ থানার দাসপাড়া এলাকায় এক বৃদ্ধ, রণদির দাস (৬৫), তার ঘরের ফ্যানের সঙ্গে চাদর বেঁধে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। পুলিশ জানিয়েছেন, তার মানসিকভাবে কিছুটা বিকারগ্রস্ত হওয়ার ইতিহাস ছিল, যা এই আত্মহত্যার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
সিলেটে আত্মহত্যার সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতির মধ্যে ফাঁস দেওয়া রয়েছে বিশেষ করে শহরের বাইরে বা গ্রামীণ এলাকায় যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য-সেবা সহজলভ্যতা কম। এছাড়া, বঞ্চনা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং পারিবারিক দ্বন্দ্বও প্রভাবশালী কারণ হিসেবে উঠে এসেছে।
গবেষণা ও রিপোর্টগুলোর আলোকে দেখা যায়, সিলেটের তরুণ প্রজন্ম, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা, আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের মধ্যে একাংশ অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও পরিবার থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা না পাওয়া, অন্যরা সামাজিক চাপ এবং আত্মসম্মান নষ্ট হওয়ায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।
একটি সাম্প্রতিক মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বলেছে যে সিলেট বিভাগে আত্মহত্যার প্রবণতা অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি — বিশেষত যুবকদের মধ্যে। এছাড়া, পরিবারগত অস্থিরতা, পারিবারিক মার্জিন, এবং মানসিক স্বাস্থ্যজনিত অবস্থা এমন গঠনমূলক কারণ যা শিক্ষার্থীদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
সিলেটে আত্মহত্যা প্রতিহত করার জন্য ইতিমধ্যেই কিছু সুপারিশ করা হচ্ছে। প্রথমত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কাউন্সেলিং সেন্টার স্থাপন করা এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মশালা চালু করা জরুরি।
দ্বিতীয়ত, জনসাধারণ এবং পরিবারগুলোকে মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যার ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করতে সম্প্রচারের উদ্যোগ নিতে হবে। মিডিয়া, সমাজসেবী সংস্থা এবং সরকার মিলিয়ে “জীবন-মান রাখি” বা এমন ক্যাম্পেইন চালাতে পারে যেখানে মানসিক সহায়তার পথগুলোর দিকে মনোনিবেশ করা হবে।
তৃতীয়ত, প্রশাসনকে স্থানীয় পর্যায়ে হটলাইন এবং জরুরি সাপোর্ট সার্ভিস গঠন করতে হবে, যেখানে মানসিক সমস্যায় থাকা ব্যক্তিরা সহজে যোগাযোগ করতে পারবে এবং অবিলম্বে সহায়তা পাবে।
সর্বোপরি, সিলেটে আত্মহত্যা বৃদ্ধির এই ধারা থামাতে প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ, সরকার ও মনস্তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের একত্রে কাজ করতে হবে। শুধুমাত্র সচেতনতা বাড়িয়ে নয়, কার্যকর সহায়তা ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে হবে যাতে সিলেটের মানুষের জীবনের মূল্য বোঝা যায় এবং মানসিক সংকট থেকে সুরাহা পাওয়া যায়।