সম্পাদক: মুহাম্মদ জাকির হোসাইন
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিএনপি একটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের হাতে দলটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু, আর সেই থেকেই বিএনপি দেশের ক্ষমতার রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে আসছে। ১৯৯১–৯৬ এবং ২০০১–০৬—এই দুই দফায় বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, আর এই শাসনামল নিয়ে বহু বিতর্ক, অভিযোগ ও মতানৈক্য আজও আলোচিত। গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ, উন্নয়নের পথচলা ও আইনের শাসন—সব প্রশ্নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিএনপি শাসনামলের অভিজ্ঞতা ও তার জটিল উত্তরাধিকার।
এক. সহিংসতা ও চরম রাজনৈতিক অস্থিরতার অভিযোগ
বিরোধী রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন অভিযোগ করেছে যে তখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বারবার টালমাটাল হয়ে পড়েছিল। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর হামলা, বন্দুকধারীদের দৌরাত্ম্য, অপহরণ, বোমা–গ্রেনেড হামলা—এসব হঠাৎই যেন রাজনীতির অস্বাভাবিক ‘স্বাভাবিকতা’ হয়ে দাঁড়ায়।
রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও বিরোধী দল নিধন
বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের ওপর নির্যাতন, রাজনৈতিক দলের সমাবেশে হামলা, মামলা বা হুমকি—এসব অভিযোগ বিএনপি শাসনামলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক। বিশেষ করে ২০০১–০৬ সময়কালে, বিরোধী দলের সদস্যদের ওপর হামলা ও হত্যা–অপরাধের ঘটনা জনমনে আতঙ্ক তৈরি করে। এই সময়কালে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার চেষ্টা দেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে বিষম ও উত্তেজনাপূর্ণ করে তোলে।
দুই. সংখ্যালঘু নির্যাতন
বিএনপি শাসনামলের সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা বিশেষভাবে চিন্তার বিষয়। বিশেষ করে হিন্দু ও আদিবাসী সম্প্রদায় লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকে। মানবাধিকার সংস্থা ও সংবাদ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে—দোকান, বাড়ি, মন্দির ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান লক্ষ্যবস্তু হয়ে ছিল।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতার ঘটনা শুধু মানবাধিকারের প্রশ্নই তৈরি করে না, এটি সামাজিক বিভাজন, অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা এবং দীর্ঘমেয়াদি আতঙ্কের সৃষ্টি করে। যদিও প্রশাসন এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে, এবং অনেক সময় ঘটনার দায় স্থানীয় ‘দলের ছত্রছায়ার’ উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, বাস্তবতা হলো—সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়গুলো দীর্ঘ সময় আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন।
তিন. ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার প্রশ্ন
এই সময়ে সংঘটিত অপরাধের বিচার হয়নি বা দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে গেছে। বিরোধী রাজনৈতিক মহলের অভিযোগ—দলের ভেতরকার কিছু প্রভাবশালী অংশের ‘তদবির সংস্কৃতি’ ও ‘দলীয়করণ’ প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকে দুর্বল করে দেয়।
নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সংখ্যালঘু নিধন ঘটনার মিল প্রমাণ করে যে, প্রশাসন অনেক সময় নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
চার. জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদ শক্তির উত্থান: এক বিতর্কিত অধ্যায়
বিএনপি শাসনামলে জঙ্গিবাদের উত্থান ছিল। বিশেষ করে ২০০১–০৬ সময়কালে জেএমবিসহ বিভিন্ন উগ্রবাদী সংগঠন বিস্তার ও দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা ঘটায়।
বিরোধীরা দাবি করে—প্রশাসন যথাসময়ে জঙ্গিবাদ দমন করতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার অবশ্য বারবার বলেছে যে, তারা কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিল।
পাঁচ. দুর্নীতি ও প্রশাসনিক দলীয়করণ
অধিকাংশ বিশ্লেষক মনে করেন—দলীয় নিয়ন্ত্রণ, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনকে উসকে দিয়েছে। এই সময়ে বিরোধী দলের নিধন এবং সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা, প্রশাসনের অকার্যকর পদক্ষেপের সঙ্গে মিলে, জনমনে গভীর অবিশ্বাস তৈরি করে।
ছয়. গণতন্ত্রের পথরেখা ও বিএনপির রাজনৈতিক শিক্ষা
বিএনপি শাসনামলের ইতিবাচক দিক যেমন—সড়ক যোগাযোগ উন্নয়ন, রপ্তানি শিল্প সম্প্রসারণ, টেলিযোগাযোগ খাতে বেসরকারিকরণ—এগুলো থাকলেও, সহিংসতা, দুর্নীতি, সংখ্যালঘু নির্যাতন ও বিরোধী দল নিধনের মতো ঘটনা এগুলোকে গভীরভাবে ছাপিয়ে যায়।
গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে তখনই, যখন রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ভুল সৎভাবে বিশ্লেষণ করবে, এবং জনগণকে সত্য ও নিরাপত্তার পথে অটল রাখবে।
সাত. বিএনপির সামনে আজকের চ্যালেঞ্জ
বিএনপি যদি ভবিষ্যতে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে চায়, তবে অতীতের সহিংসতা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, বিরোধী দল নিধন, দুর্নীতি এবং জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্ট সব প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিতে হবে। পাশাপাশি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে—যেখানে রাজনৈতিক সহনশীলতা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করা হবে।