ধর্ম
ইসলামে হজ এবং উমরা হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মুসলিমদের পালনীয় গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। হজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি এবং এটি ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিটি মুসলিমের জন্য জীবনে অন্তত একবার পালন আবশ্যক। উমরা যদিও ফরজ নয়, তবে এটি অত্যন্ত মহিমান্বিত এবং হজের একটি সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে বিবেচিত হয়। উমরা ও হজের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ একনিষ্ঠতা, আত্মশুদ্ধি ও ঈমানকে শক্তিশালী করা।
কোরআনে আল্লাহ বলেন:
“আর হজ ও উমরা সম্পন্ন কর; মানুষজনকে আল্লাহর পথের দিকে আহবান কর।”
(সূরা আল-বাকারা, ২:১৯৭)
উমরা ও হজের পার্থক্য
উমরা ও হজ উভয়ই মক্কায় কাবা শরীফের তাওয়াফ ও সাঈয়ের মাধ্যমে পালন করা হয়, কিন্তু সময়কাল ও কিছু বিধিনিষেধে পার্থক্য রয়েছে।
উমরা:
হজ:
হাদিসে নবী করীম (সা.) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি ক্ষমতা সম্পন্ন হয়ে হজ করতে পারে কিন্তু তা পরিত্যাগ করে, আল্লাহর প্রতি অবাধ্যতা করেছে।”
(সাহিহ বুখারি, হাদিস: ১৪৮১)
ইহরাম: উমরা ও হজের শারীরিক ও আত্মিক প্রস্তুতি
ইহরাম হলো উমরা বা হজ শুরু করার পূর্বে মুসলিমদের জন্য নির্দিষ্ট পোশাক ও ইবাদতের অবস্থায় নিজেকে নিবেদিত করা। পুরুষরা দুইটি সাদা কাপড় ব্যবহার করেন এবং মহিলারা সরল পোশাক পরিধান করেন।
ইহরামের সময় কিছু কাজ নিষিদ্ধ থাকে, যেমন: শারীরিক সম্পর্ক, তর্ক-বিতর্ক, চুল কেটে নেওয়া বা নখ কাটানো।
নবী করীম (সা.) বলেছেন:
“ইহরামের অবস্থায় থাকা মুসলিম আল্লাহর প্রতি নিষ্ঠার নিদর্শন।”
(সাহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৩১৬)
ইহরামের মূল উদ্দেশ্য হলো আত্মশুদ্ধি ও ধৈর্য অর্জন।
উমরা ও হজের মূল ইবাদতসমূহ
১. তাওয়াফ (Kaaba প্রদক্ষিণ):
তাওয়াফ হলো কাবার চারপাশে সাতবার ঘূর্ণন করা। এটি আল্লাহর সামনে বিনয় ও আনুগত্যের চিহ্ন। কোরআনে বলা হয়েছে:
“আর ঘোরো কাবার চারপাশে, যা তোমাদের জন্য মানুষের জন্য প্রমাণ।”
(সূরা আল-বাকারা, ২:১৯৯)
২. সাঈ (সাফা-মারওয়া হেঁটে চলা):
সাঈ হলো সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে সাতবার যাত্রা। এটি হজের এবং উমরার একটি অংশ। নবী হযরত হাজারা (রা.) এর কঠোর পরিশ্রম এবং সন্তানের জন্য আল্লাহর প্রতি ভরসার গল্পের স্মৃতিস্বরূপ এটি পালন করা হয়।
৩. ন্যাফল ও দোয়া:
উমরা ও হজের সময় মুসলিমরা আল্লাহর দোয়া ও নাফল ইবাদত করেন। তাওয়াফের সময় দোয়া বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নবী করীম (সা.) বলেছেন:
“তাওয়াফের সময় যে কোনো ন্যাফল দোয়া আল্লাহ তা’আলার কাছে গ্রহণযোগ্য।”
(সাহিহ বুখারি, হাদিস: ১৫১৮)
৪. কুরবানী (হজের সময়):
হজের ফরজ অংশ হিসেবে নির্দিষ্ট পশু কুরবানী করা হয়, যা আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও ধৈর্যের প্রতীক। কুরবানী মানুষের মধ্যে সহযোগিতা, দানশীলতা ও উদারতার শিক্ষা দেয়।
উমরা ও হজের মানসিক ও সামাজিক গুরুত্ব
উমরা ও হজ কেবল আধ্যাত্মিক নয়, সামাজিক শিক্ষা ও ঐক্যের প্রতীক। মুসলিমরা বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতির মানুষদের সাথে একত্রে ইহরামের অভ্যাস পালন করে। এটি ইসলামের ভ্রাতৃত্ববোধ ও একতার চিহ্ন।
হজের সময় বিশেষভাবে আরাফাত ময়দানে দাঁড়ানো হলো মানুষের পাপমুক্তির সময়। নবী করীম (সা.) বলেছেন:
“হজের মূল অংশ হলো আরাফাতের দিন দাঁড়ানো; এ দিনের প্রার্থনা ও তওবাহ আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য।”
(সাহিহ বুখারি, হাদিস: ১৫৫৩)
উমরায় ভক্তি ও ধৈর্যের শিক্ষা এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের অনুভূতি গড়ে ওঠে।
উমরা ও হজের আধ্যাত্মিক ফলাফল
কোরআনে আল্লাহ বলেন:
“হজ এবং উমরা আমারই জন্য; তাই যারা এই ইবাদত পালন করবে, তারা আমার কাছে আসবে।”
(সূরা আল-হাজ্জ, ২২:২৭–২৯)
উমরা ও হজ পালন সংক্রান্ত আধুনিক বাস্তবতা
বর্তমান সময়ে উমরা ও হজে অংশগ্রহণের জন্য বিশেষ নিয়মাবলী রয়েছে, যেমন: ভিসা, স্বাস্থ্যবিধি, প্যাকেজ ট্যুর। কোভিড-১৯ মহামারির পর স্বাস্থ্য ও সামাজিক দূরত্বের মান বজায় রেখে উমরা ও হজে মুসলিমরা অংশ নিচ্ছেন।
ল্যাবরেটরি গবেষণা ও প্রযুক্তি:
উমরা ও হজের জন্য ডিজিটাল বুকিং, স্বাস্থ্য ট্য্র্যাকিং এবং জিপিএস গাইডেন্স ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে উমরা ও হজ আরও সুসংগঠিত ও নিরাপদ হয়েছে।
উমরা ও হজ মুসলিমদের আধ্যাত্মিক জীবনের অঙ্গ। কোরান ও হাদিসের নির্দেশ অনুসারে, এটি আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, আত্মশুদ্ধি এবং মানবজাতির মধ্যে সৌহার্দ্য বৃদ্ধির এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত।
উমরা এবং হজ কেবল ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা নয়, বরং মুহূর্তিক আধ্যাত্মিক প্রশান্তি ও সামাজিক একতার প্রতীক। মুসলিমরা এই ইবাদত পালন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, পাপমুক্তি এবং জীবনধর্মের উন্নতি নিশ্চিত করে।