সম্পাদক: মুহাম্মদ জাকির হোসাইন
বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার উত্থান একটি অনন্য ও জটিল ঐতিহাসিক অধ্যায়। তিনি এমন এক নেতা, যার রাজনৈতিক যাত্রার শুরু ব্যক্তিগত জীবনের হঠাৎ করেই পালটে যাওয়া পরিস্থিতি থেকে, কিন্তু যার নেতৃত্বগুণ তাকে পরবর্তীতে দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তিতে পরিণত করেছে। একজন নারী হিসেবে তিনি যে প্রতিকূল পরিবেশে উঠে এসেছেন, তা শুধু রাজনৈতিক ইতিহাসের অংশই নয়, বরং বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামো ও ক্ষমতার রাজনীতির পরিবর্তনকেও ইঙ্গিত করে।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরুই হয়েছিল এক অপ্রত্যাশিত মুহূর্ত থেকে। তিনি ছিলেন মূলত প্রচলিত অর্থে এক গৃহিণী। তাঁর স্বামী, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, সামরিক শাসক থেকে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠার পরও খালেদা জিয়া ছিলেন রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরে।
১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশকে শুধু রাজনৈতিক অস্থিরতার গভীরে ফেলেনি, বরং জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বিএনপি হয়ে পড়েছিল দিকনির্দেশনাহীন। এই পরিস্থিতিতে দলের নেতাকর্মীরা নেতৃত্বের জন্য এমন একজন ব্যক্তিকে প্রয়োজন বোধ করেছিলেন যিনি প্রতীকী ঐক্যের কেন্দ্র হতে পারেন। সেই প্রতীকি শক্তি হিসেবে তাঁরা দেখেছিলেন খালেদা জিয়াকে।
একজন তরুণী বিধবা নারী তখন রাষ্ট্র ক্ষমতা, রাজনীতি ও দলের ভবিষ্যতের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এলেন। তাঁর প্রথম রাজনৈতিক পরিচয় ছিল “জিয়ার সহধর্মিণী”, কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রমাণ করেছে তিনি নিজের যোগ্যতায় সেই অবস্থান ছাড়িয়ে স্বাধীন এক রাজনৈতিক শক্তিতে রূপ নিয়েছেন।
খালেদা জিয়ার উত্থানে সামরিক রাজনীতির পটভূমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর সেনাবাহিনীর ভেতর এবং বাইরে ক্ষমতার লড়াই চলছিল। বিএনপি–যা মূলত সামরিক শাসনের হাত ধরে বেড়ে ওঠা একটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট সেই অবস্থায় এমন কাউকে চাইছিল, যার জনপ্রিয়তা দলকে এক রাখতে পারে, আর সেই জনপ্রিয়তার কেন্দ্র ছিল জিয়া পরিবার।
খালেদা জিয়া সেই শূন্যস্থান পূরণ করেন। তাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ ছিল না স্বতঃস্ফূর্ত; ছিল পরিস্থিতির চাপ ও ক্ষমতার গঠনমূলক প্রয়োজন। তবুও তিনি অসাধারণ দৃঢ়তা দেখিয়েছিলেন। যেখানে তৎকালীন সময়ের রাজনীতি পুরুষতান্ত্রিক ছিল, সেখানে একজন নারী দলের নেতৃত্ব নেবেন—এটি ছিল নজিরবিহীন। খালেদা জিয়া সেই সীমা ভেঙেছেন।
বিএনপির পুনর্গঠনে যুবদল ও ছাত্রদলের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। খালেদা জিয়া দলীয় নেতাকর্মীদের সক্রিয় করতে প্রথমেই সংগঠন পুনর্গঠনের ওপর জোর দেন। সংসদীয় রাজনীতিতে তখনো তিনি ছিলেন নবীন, কিন্তু দলের ভেতর তাঁর জনপ্রিয়তার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল মাঠের সংগঠনগুলোতে।
রাজনৈতিক পরিস্থিতিও তাঁর পক্ষে ছিল। তৎকালীন সামরিক শাসনবিরোধী পরিবেশ, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি, ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতা সব মিলিয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির নতুন রূপ স্পষ্ট হতে থাকে।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, তিনি সরাসরি ছাত্র-জনতার ভাষা ব্যবহার করতেন না, বরং শান্ত, সংযত ও দৃঢ় রাজনৈতিক ভাষা প্রয়োগ করতেন। এটি তাকে সাধারণ মানুষের কাছে ‘বোঝাপড়ার’ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
১৯৯১ সালের নির্বাচন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্থানের প্রকৃত মোড়। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পর দেশের প্রথম নির্বাচনেই বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং তিনি প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। দেশে তখনো নারীদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রহণে সমাজ মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। সে অবস্থায় খালেদা জিয়া দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া শুধু রাজনৈতিক সাফল্য নয় সমাজ পরিবর্তনের প্রতীকও।
তাঁর নেতৃত্বে
তাঁর কঠোর রাজনৈতিক অবস্থান কখনো সমালোচিত হয়েছে, কিন্তু তাঁর জনপ্রিয়তা কখনো হঠাৎ করে ভেঙে পড়েনি। বরং ক্ষমতার চূড়ায় থেকেও তিনি দলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সফল হয়েছিলেন।
খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় রাজনৈতিক রূপ স্পষ্ট হয় ১৯৯৬ সালে। তখন তিনি রাজপথের আন্দোলনে দলকে নেতৃত্ব দেন। তাঁর অনুগত নেতাকর্মীরা তাঁকে “মাদার অফ ডেমোক্রেসি” বলে আখ্যা দেন। অবশ্যই, এটি রাজনৈতিক ব্যাখ্যা, কিন্তু তাঁর ভূমিকার তাৎপর্য অস্বীকার করা যায় না।
রাজনীতির কঠোর পরিবেশে তিনি যে দৃঢ় অবস্থান নেন, তা বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতিকে আরও শক্ত করে। তিনি রাজনৈতিক লড়াইয়ে আপসহীন চরিত্রের প্রতীক হয়ে ওঠেন বন্ধুসুলভ নয়, বরং কঠোর নেতা। এবং এখানেই তাঁর উত্থানের নতুন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে শক্তিশালী নারী নেতৃত্বের নতুন মান তৈরি করেছিলেন।
২০০১ সালে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মাধ্যমে তাঁর ক্ষমতার উচ্চতা আরও বিস্তৃত হয়। এই পর্যায়ে দেশের প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতি-পরিকল্পনায় তাঁর প্রভাব দৃষ্টিগোচর ছিল। যদিও এই সময় নানা বিতর্ক, দুর্নীতি অভিযোগ ও সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থতার ইস্যু সামনে আসে, খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা তখনো টিকে ছিল।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, যা তাঁর রাজনৈতিক চরিত্রে আরেকটি বাঁক আনে। এই সময় তিনি একজন নেতা হিসেবে আরও দৃঢ় হয়ে ওঠেন, এবং এখান থেকেই তাঁর সংগ্রামী চরিত্রটি আরও জোরালোভাবে সামনে আসে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপস্থিতি সীমিত হলেও তাঁর প্রভাব অপরিবর্তিত। তাঁর স্বাস্থ্য, কারাবাস, চিকিৎসা এবং রাজনৈতিক অবরুদ্ধতা তাঁকে দুর্বল করে দিলেও, তিনি এখনো বিএনপির প্রতীকী কেন্দ্র।
বিএনপির রাজনীতিতে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা এতটাই গভীর যে, সক্রিয় রাজনীতি করতে না পারলেও দলের কর্মসূচি, কৌশল ও নেতৃত্ব কাঠামো তাঁর ভূমিকার ওপর নির্ভরশীল থাকে। এটি দেখায় ক্ষমতা কমে গেলেও নেতৃত্বের চরিত্র কখনো হারিয়ে যায় না।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্থান থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়—
১. পরিস্থিতি মানুষ তৈরি করে
তিনি নিজের ইচ্ছায় রাজনীতিতে আসেননি; ঘটনাপ্রবাহ তাঁকে সামনে ঠেলে দিয়েছে।
২. নারীর নেতৃত্ব সমাজ পরিবর্তনের প্রতীক
তিনি পুরুষ-প্রধান রাজনীতিতে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নারীর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের নতুন দিগন্ত খুলেছেন।
৩. সংগঠনই রাজনীতির শক্তি
সংগঠন পুনর্গঠন করে তিনি বিএনপিকে শক্তিশালী করেছেন—যা তার উত্থানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
৪. প্রতীকী নেতৃত্ব কখনো কখনো বাস্তব নেতৃত্বের চেয়েও শক্তিশালী
খালেদা জিয়া শুধুই জিয়ার সহধর্মিণী ছিলেন না—তিনি নিজের রাজনৈতিক চরিত্র গড়ে তুলেছেন।
৫. রাজনীতি সবসময় সরল নয়—ক্ষমতা ও বিরোধিতার যুগল উপস্থিতি উত্থানের গতিপথ নির্ধারণ করে
তাঁর ক্যারিয়ারে একইসঙ্গে জনপ্রিয়তা, বিতর্ক ও সংগ্রাম জড়িয়ে আছে।
খালেদা জিয়ার উত্থান বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। তিনি এমন এক নারী, যিনি ব্যক্তিগত শোককে পরিণত করেছেন রাজনৈতিক শক্তিতে; যিনি প্রতিকূলতাকে পরিণত করেছেন নেতৃত্বে; যিনি শক্ত হাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দলকে।
তাঁর উত্থান শুধু রাজনৈতিক নয়,এটি সামাজিক মনস্তত্ত্ব, রাষ্ট্রক্ষমতার রূপান্তর এবং লিঙ্গভিত্তিক নেতৃত্বের নতুন সংজ্ঞা।
তিনি এখন রাজনৈতিকভাবে যতই সীমাবদ্ধ থাকুন না কেন, বাংলাদেশের আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে তাঁর উত্থান এবং অবদান অমোচনীয়।