দেশের চিত্র ডেস্ক
২০২৪ সালের আগস্টে প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তনের পর বাংলাদেশে প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার রূপান্তর শুরু হয়। দীর্ঘ ১৫ বছর শাসন পরবর্তী সময়ের এই পরিবর্তন শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমিত ছিল না, বরং দেশের পুলিশ বাহিনীও এসময় নজরে আসে। নতুন সরকার, ড. ইউনুসের নেতৃত্বে, পুলিশকে পুনর্গঠন ও দুর্নীতি কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে প্রায় দেড় বছরের মধ্যে দেখা গেছে যে, পুলিশের অবস্থা এখনো সংকটাপন্ন, এবং জনগণের আস্থা পুরোপুরি পুনঃস্থাপন হয়নি।
পুলিশের দুর্নীতি বাংলাদেশে নতুন কোনো বিষয় নয়। পূর্ববর্তী বছরগুলোতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ সূচক দেখিয়েছিল, দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের শিকার। Transparency International-এর ২০২২ সালের রিপোর্টে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দুর্নীতিপ্রবণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। দেশের সাধারণ মানুষও অনেক আগে থেকেই পুলিশের মধ্যস্থতা, ঘুষ, রিমান্ডে হয়রানি, আর মামলা গঠনের মতো অনিয়মের অভিজ্ঞতা জানিয়ে আসছে।
নতুন সরকারের অধীনে, পুলিশ বাহিনীতে কিছু রদবদল ও অব্যাহতি করা হয়। উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এবং যারা আগের রাজনৈতিক শাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, তাদের দায়িত্ব পরিবর্তন বা অপসারণ করা হয়। পাশাপাশি, পুলিশের পুনর্গঠনের জন্য সরকার Police Reform Commission (PRC) গঠন করে। কমিশনটি প্রধানত পুলিশের কার্যক্রম স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। তবে তদারকি ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়া ধীর এবং সীমিত।
সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ১৬–১৮ মাসে পুলিশ বিভাগের বিরুদ্ধে ১,৩২৮টি দুর্নীতি‑সংক্রান্ত অভিযোগ দাখিল হয়েছে। এর মধ্যে ১৭৮ জন কর্মকর্তা বিভাগীয় ব্যবস্থার মুখোমুখি হয়েছেন। এসব পরিসংখ্যান দেখিয়ে দেয় যে, দুর্নীতি শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে নয়, বরং গঠনমূলক এবং বহুস্তরীয়। নতুন সরকারের উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও, পুরনো নেটওয়ার্ক, রাজনৈতিক প্রভাব, এবং সিস্টেমিক দুর্নীতি এখনও সক্রিয়।
দুর্নীতির ধরনও বহুমাত্রিক। নিয়োগ ও বদলির ক্ষেত্রে ঘুষ নেওয়া, পদোন্নতি নিশ্চিত করার জন্য অনৈতিক পদ্ধতি, মামলার সঙ্গে আঁতাত, রিমান্ডে নির্যাতন ও অর্থ আদায়, রাস্তা বা হকারদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি — এসব এখন নিত্যদিনের ঘটনা। সাধারণ নাগরিক যখন পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র বা অন্যান্য সরকারি সেবা পেতে চায়, তখনও প্রক্রিয়ার মধ্যে পুলিশী মধ্যস্থতা বা ঘুষ বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে। এসব কার্যক্রম শুধু অপরাধমূলক নেটওয়ার্ককে শক্তিশালী করে না, বরং দেশের বিচার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়ে দেয়।
জনগণের আস্থা ও প্রতিক্রিয়া এই সব পরিস্থিতিকে প্রতিফলিত করে। সম্প্রতি করা এক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ চায় পুলিশ রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত ও নিরপেক্ষ হোক। প্রায় ৭৮ শতাংশ মানুষ চাইছেন পুলিশ দুর্নীতিমুক্ত হোক এবং দায়বদ্ধ হোক। তবে বাস্তবে অভিযোগের প্রতিকার, শাস্তি বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা খুব সীমিত। ফলে সাধারণ মানুষ পুলিশের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে। বিশেষ করে Section 167 CrPC-এর রিমান্ড ব্যবস্থায় জনগণের ভয় রয়েছে। অভিযোগ ও মামলা রিম্যান্ডে আটক থাকা অবস্থায় নির্যাতন ও অর্থ আদায় করা হচ্ছে এমন তথ্য থাকায় মানুষ এই ব্যবস্থার প্রতি অসন্তুষ্ট।
নতুন সরকার ও PRC এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। অনলাইন জিডি (General Diary) বা অভিযোগ/মামলার ডিজিটাল রেকর্ড চালু করা হয়েছে। এটি মূলত হাতে লেখা জিডি ও মধ্যস্থতা কমানোর উদ্দেশ্যে। রিমান্ড কক্ষে স্বচ্ছ কাচ, সিসিটিভি স্থাপন এবং তদারকি ব্যবস্থাও চালু করার প্রস্তাব রয়েছে। তাছাড়া, প্রতিটি থানা বা উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় পর্যায়ে “all‑party oversight committee” গঠন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যা পুলিশ কর্মকাণ্ড তদারকি করবে এবং জনসাধারণের অভিযোগ দ্রুত সমাধান নিশ্চিত করবে।
তবে সমস্যাগুলি দূর করার পথে বাধা অপ্রতুল বাজেট, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, পুরনো নেটওয়ার্কের প্রভাব এবং তদারকি ব্যবস্থার ধীরগতির কারণে এখনও অনেক। অনেক থানা বা বিভাগের জন্য বাজেট ও সরঞ্জাম পর্যাপ্ত নয়। রিমান্ড কক্ষ ও পুলিশ অফিসের আধুনিকায়ন অসম্পূর্ণ, যা কর্মকর্তাদের মধ্যস্থতা বা ঘুষের প্রতি নির্ভরশীল করে তোলে। এছাড়া, রাজনৈতিক প্রভাব ও পুরনো প্রশাসনিক নেটওয়ার্ক নতুন নির্দেশনার প্রভাবকে সীমিত করছে।
পুলিশের সংস্কার প্রক্রিয়ার ধীরগতির কারণে সাধারণ জনগণ এখনও আস্থাহীন। কিছু স্থানীয় পর্যায়ে পরিবর্তন হলেও, গঠনমূলক দুর্নীতি ও অপরাধীদের সঙ্গে আঁতাত এখনও রয়ে গেছে। সংবাদপত্র ও স্বাধীন বিশ্লেষকরা বলছেন, “যখন শূন্য‑সহিষ্ণু নীতি ঘোষণা করা হলেও, বাস্তবে শাস্তি কার্যকর হচ্ছে না বা খুব কম হচ্ছে।” অনলাইন জিডি সিস্টেম চালু হলেও সার্ভারের ধীরতা এবং প্রক্রিয়ার জটিলতা মানুষের অভিযোগ দাখিল করতে বাধা দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, পুলিশের পুনর্গঠন এক দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। শুধুমাত্র পদোন্নতি বা বদলি, শাস্তি, এবং নতুন কমিশন গঠনের মাধ্যমে দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব নয়। সরকারের প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, পর্যাপ্ত বাজেট, অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বচ্ছ নিয়োগ ও বদলির পদ্ধতি এবং জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশের অবস্থার সামগ্রিক চিত্র হলো একটি সংকটাপন্ন মধ্যপথ। কিছু নতুন উদ্যোগ শুরু হলেও পুরনো নেটওয়ার্ক, রাজনৈতিক প্রভাব, আর্থিক সীমাবদ্ধতা ও গঠনমূলক দুর্নীতি এখনও সক্রিয়। পুলিশের সংস্কার ও পুনর্গঠন দীর্ঘমেয়াদী, সুপরিকল্পিত ও ধারাবাহিক পদক্ষেপ ছাড়া সফল হবে না।
সার্বিকভাবে বলা যায়, জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপন এবং পুলিশকে দুর্নীতিমুক্ত, জনবান্ধব ও নিরপেক্ষ করার কাজ এখনো শুরু। এই প্রক্রিয়া সফল হলে দেশের আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসন পুনরায় শক্তিশালী হবে, নাগরিক জীবনে নিরাপত্তা ও সেবা নিশ্চিত হবে। তবে তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুশৃঙ্খল প্রশাসনিক বাস্তবায়ন এবং দীর্ঘমেয়াদী মনোবল।