1. desherchitrabd@gmail.com : Desher DesherChitra : Desher Chitra
সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ১১:৫২ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম :

কুরবানী: ইতিহাস, গুরুত্ব ও শিক্ষা

  • আপডেট টাইম : শুক্রবার, ৬ জুন, ২০২৫

সম্পাদক : মুহাম্মদ জাকির হোসাইন

ইসলাম ধর্মে কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যা ঈদুল আযহার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কুরবানী শব্দটি আরবি “قربان” (কুরবান) থেকে এসেছে, যার অর্থ নৈকট্য লাভ বা আত্মোৎসর্গ। এটি মূলত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কিছু ত্যাগ করার প্রতীক। কুরবানী শুধুমাত্র একটি পশু জবাইয়ের অনুষ্ঠান নয়, বরং তা আত্মশুদ্ধি, মানবিকতা, এবং ঈমানের দৃঢ়তার এক চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ।

কুরবানীর মূল ইতিহাস জড়িয়ে আছে নবী ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.) এর সাথে। এক রাতের স্বপ্নে ইব্রাহিম (আ.) দেখেন তিনি তাঁর পুত্রকে আল্লাহর পথে কুরবানী করছেন। এই স্বপ্ন পরপর তিন রাতে আসার পর, তিনি নিশ্চিত হন যে এটি কোনো স্বাভাবিক স্বপ্ন নয়, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে এক নির্দেশ।

তিনি তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে নিয়ে এই কুরবানী আদায়ের প্রস্তুতি নেন। ইসমাইল (আ.)-এর জবাইয়ের মুহূর্তে আল্লাহ তাঁর আনুগত্যের পরীক্ষা সফল হয়েছে বলে জানিয়ে একটি পশু (দুম্বা) পাঠান, যেটিকে জবাই করা হয়। এই ঘটনার স্মরণে মুসলিমরা হজের শেষে ঈদুল আযহা উদযাপন করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু কুরবানী করে।

কুরআনের বর্ণনা: “যখন তারা (ইব্রাহিম ও ইসমাইল) আত্মসমর্পণ করল এবং ইব্রাহিম তাকে কাত করে শুইয়ে দিল, তখন আমি (আল্লাহ) বললাম, হে ইব্রাহিম! তুমি স্বপ্নের সত্যতা প্রমাণ করেছ। নিঃসন্দেহে আমি সৎকর্মপরায়ণদের এভাবেই পুরস্কৃত করি।”
সূরা আস-সাফফাত: ১০৩-১০৫

এই কাহিনী শুধুমাত্র ইতিহাস নয়, এটি ত্যাগ, আনুগত্য ও ঈমানের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।

ইসলামে কুরবানী ওয়াজিব (বাধ্যতামূলক) ইবাদত, যা হিজরি বছরের ১০-১২ জিলহজ্জ তারিখে আদায় করা হয়। যে মুসলমান বালেগ, আকলবান, এবং নির্দিষ্ট আর্থিক ক্ষমতার অধিকারী, তার জন্য কুরবানী করা ওয়াজিব।

হাদীসে রাসূল (সা.) বলেছেন:

যে ব্যক্তি কুরবানীর সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে না আসে।”
— (মুসনাদে আহমদ: ৫২৪৫)

আল্লাহ কুরআনে স্পষ্টভাবে বলেছেন:

তাদের গোশত এবং রক্ত আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না; বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।”
— (সূরা হজ: ৩৭)

এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, কুরবানীর বাহ্যিক রূপ নয়, বরং এর অন্তর্নিহিত ইচ্ছা, ত্যাগ ও আল্লাহর প্রতি ভক্তিই আসল বিষয়।

আধুনিক প্রেক্ষাপটে কুরবানীর গুরুত্ব:

১. মানবিক মূল্যবোধের চর্চা

কুরবানীর মাংস তিন ভাগে ভাগ করার শিক্ষা সমাজে সম্প্রীতি, সমবেদনা এবং সম্পদ ভাগাভাগির শিক্ষা দেয়। গরীবদের প্রতি সহানুভূতির প্রকাশ ঘটে।

২. সমাজে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব

ঈদের দিন ধনী-গরীব সবাই এক কাতারে নামাজ পড়ে, একসাথে কুরবানীর আয়োজন করে, এবং কুরবানীর মাংস সবাই ভাগ করে খায়। এতে শ্রেণীভেদের দেয়াল ভাঙে।

৩. আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংযম

কুরবানীর মাধ্যমে একজন মুমিন তার ভোগবিলাস, অহংকার এবং স্বার্থপরতাকে কুরবানী করে আল্লাহর প্রতি নিজের নিবেদন প্রমাণ করে। এটি এক ধরনের আত্মসংযমের প্রশিক্ষণ।

বৈজ্ঞানিক ও স্বাস্থ্যগত দৃষ্টিকোণ:

১. পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা

কুরবানীর পশুর মাংসে থাকে উচ্চমানের প্রোটিন, আয়রন, ভিটামিন বি১২, জিঙ্ক, ওমেগা-৩ ইত্যাদি, যা শরীরের গঠন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।

২. সুষ্ঠু জবাই প্রক্রিয়ার গুরুত্ব

ইসলামী নিয়ম অনুযায়ী পশুকে কষ্ট না দিয়ে দ্রুত ও স্বচ্ছভাবে জবাই করার নিয়ম রয়েছে, যাকে “ধারালো ছুরি দিয়ে হালাল উপায়ে জবাই” বলা হয়। এই পদ্ধতিতে পশু কম যন্ত্রণায় মারা যায় এবং রক্ত সম্পূর্ণ বের হয়ে যায়, যা মাংসকে স্বাস্থ্যকর রাখে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং FAO এর মতে, পরিষ্কার পরিবেশে ও সংক্রমণ রোধের ব্যবস্থায় কুরবানী করলে জনস্বাস্থ্যের কোনো হুমকি থাকে না।

সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ ও কুরবানীর বিবেকপূর্ণ প্রয়োগ:

১. পরিবেশ রক্ষা

বিশেষ করে শহরাঞ্চলে কুরবানীর সময় সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে দূষণ ঘটে। ইসলামী নীতিতে পরিবেশ রক্ষা করাও একটি ইবাদত। তাই স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণের উচিত একসাথে কাজ করে পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা।

২. সামাজিক সচেতনতা

বেশ কিছু মানুষ কুরবানীর প্রকৃত উদ্দেশ্য না বুঝে শুধুমাত্র বাহ্যিক প্রদর্শনীতে লিপ্ত হয় — বড় গরু, দামি পশু কেনা নিয়ে প্রতিযোগিতা করে। অথচ কুরবানীর মূল শিক্ষা হলো তাকওয়া ও আত্মত্যাগ।

৩. ভার্চুয়াল কুরবানী ও বিকল্প পন্থা

বর্তমানে অনেকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কুরবানী দিয়ে থাকেন, যেখানে পশু জবাই, মাংস বণ্টন ইত্যাদি তৃতীয় পক্ষ সম্পন্ন করে। এটি আধুনিক সমাজে সময় বাঁচানোর একটি কার্যকর উপায় হলেও, কুরবানীর আত্মিক যোগাযোগ যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, সে বিষয়েও সচেতন থাকতে হবে।

কুরবানীর শিক্ষা:

১. আনুগত্য ও ঈমান

ইব্রাহিম (আ.) এর কাহিনী আমাদের শেখায়, একজন মুমিন কিভাবে আল্লাহর আদেশের কাছে নিজের সব ভালোবাসা, চাওয়া-পাওয়াকে ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকে।

২. আত্মত্যাগ ও সংযম

কুরবানী আত্মত্যাগ ও সংযমের শিক্ষা দেয় — নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা, অন্যের জন্য উৎসর্গ করা।

৩. মানবতা ও সহমর্মিতা

দরিদ্রদের মাঝে মাংস বণ্টন করে কুরবানী সমাজে মানবতা ও সহানুভূতির চর্চা করে।

৪. সহনশীলতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ

ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মাঝে একতা সৃষ্টি হয়, পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। এটি সামাজিক ঐক্য গঠনে সহায়ক।

কুরবানী কোনো কুসংস্কার বা কেবল পশু জবাইয়ের আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি একটি মহা-ইবাদত, আত্মত্যাগের এক চূড়ান্ত উদাহরণ। এর ভেতরে রয়েছে ব্যক্তিগত চরিত্র গঠন, সামাজিক দায়িত্ববোধ, ভ্রাতৃত্ব ও মানবতার শিক্ষা।

আজকের দুনিয়ায় যেখানে স্বার্থপরতা, বিভেদ ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে, সেখানে কুরবানীর মূল শিক্ষা — ত্যাগ, আনুগত্য ও সহমর্মিতা — আমাদের নতুন আলো দেখাতে পারে।

আসুন, আমরা কুরবানীর আসল শিক্ষা হৃদয়ে ধারণ করি এবং তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করি — তবেই আমাদের কুরবানী আল্লাহর দরবারে কবুল হবে এবং সমাজে এক ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।

Share this Post in Your Social Media

এই ধরনের আরও খবর
Copyright © 2025, সাপ্তাহিক দেশের চিত্র. All rights reserved.
Weekly Desher Chitra developed by LogoMyface