দেশের চিত্র ডেস্ক
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত নতুন রাজনৈতিক সংগঠন হলো জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণ ছাত্র ও কর্মীদের নিয়ে গঠিত এ দলটি শুরু থেকেই রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে জন্মলগ্ন থেকেই দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠছে। সম্প্রতি দলের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার ব্যক্তিগত জীবনধারা নিয়ে তুমুল আলোচনার পাশাপাশি শীর্ষ নেতাদের বিলাসী জীবন, সরকারি প্রভাব ব্যবহার এবং দুর্নীতি ঘিরে দেশজুড়ে সমালোচনা চলছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা এবং এনসিপি’র অন্যতম আলোচিত নেতা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সম্প্রতি একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি অকপটে স্বীকার করেন যে মাঝে মাঝে রাতের খাবারের জন্য তিনি পূর্বাচলের তিনশ ফিট এলাকার নীলা মার্কেট কিংবা গুলশানের অভিজাত ওয়েস্টিন হোটেলে যান। তার এই সরল স্বীকারোক্তি সামাজিক মাধ্যমে হাস্যরস, ট্রল এবং সমালোচনার ঝড় তোলে।
সমালোচকরা প্রশ্ন তুলেছেন—সরকারি উপদেষ্টা হিসেবে পাওয়া সীমিত বেতন-ভাতায় কীভাবে এমন বিলাসবহুল জীবনযাপন সম্ভব? অনেকে আবার রাষ্ট্রীয় উচ্চপদে থাকা ব্যক্তিদের সুযোগ-সুবিধা ও ভোগ-বিলাসের প্রসঙ্গ টেনে আসেন।
এটাই প্রথম নয়, অতীতে দামি জুতা ব্যবহার কিংবা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন চেকিংয়ের সময় তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে গুলির ম্যাগাজিন উদ্ধার হওয়ার ঘটনাতেও তিনি সমালোচিত হয়েছিলেন। ফলে সমালোচকদের মতে, একজন তরুণ উপদেষ্টার এমন বিতর্কিত আচরণ নতুন রাজনীতির প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বেমানান।
আসিফ মাহমুদের বিরুদ্ধে আরও গুরুতর অভিযোগ তোলেন আওয়ামী লীগের সাবেক এক সংসদ সদস্যের বাসায় চাঁদাবাজির ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া জানে আলম অপু। তার ভিডিও বার্তা প্রকাশের পর বিষয়টি নতুন মাত্রা পায়।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরণের বক্তব্য রাজনৈতিকভাবে শোভন নয়। কারণ জনগণ যেভাবে পরিবর্তনের আশা নিয়ে তরুণ নেতৃত্বকে সামনে এনেছিল, সেভাবে তারা এখন নতুন দলের নেতাদের জীবনযাপন ও আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
শুধু উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ নন, এনসিপির আরও কয়েকজন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ উঠেছে। গত বছর পাঠ্যবই ছাপানোর কাজে দুর্নীতি-অনিয়ম এবং জেলা প্রশাসক নিয়োগে অবৈধ হস্তক্ষেপের অভিযোগে দলের যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এছাড়া মার্চ মাসে দলটির আরেক শীর্ষ নেতা সারজিস আলম নিজ এলাকায় বিশাল গাড়িবহর নিয়ে শোডাউন করেন। যা নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তোলে—নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া একটি দলের নেতারা কেন পুরনো রাজনীতির বিলাসী ও ক্ষমতাপ্রদর্শনমূলক পদ্ধতিতে হাঁটছে?
চলতি মাসে হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং সারজিস আলম দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করায় বিষয়টি নিয়েও বিতর্ক দেখা দেয়। বিরোধীরা দাবি করেন, এভাবে প্রভাব খাটিয়ে মামলার ভয় কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
নতুন দলের নেতাদের অনেকের বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার, অভিজাত হোটেলে নিয়মিত উপস্থিতি, এবং সরকারি প্রভাব খাটানোর অভিযোগে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। একদিকে দলটি জনআকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেয়, অন্যদিকে একই দলের নেতারা পুরনো রাজনৈতিক নেতাদের মতো বিতর্কিত জীবনধারা বেছে নিচ্ছেন।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকেও শীর্ষ নেতাদের বিলাসী জীবনযাপন ও অনিয়মের প্রশ্ন তুলেছেন দলীয় নেতারাই। যদিও প্রকাশ্যে কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি, তবে সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহর কর্মকাণ্ড ঘিরে অভিযোগের সুর স্পষ্ট।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম স্বীকার করেছেন যে পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির কিছু উপাদান দলের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, “আমরা সেটাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনছি।” তার মতে, শুরুতে নতুন দল হিসেবে নেতৃত্বের মধ্যে যে রাজনৈতিক পরিপক্বতা প্রয়োজন, তা সবার মধ্যে নেই।
তবে দলীয় ভেতরের এই আত্মসমালোচনা জনমনে আস্থা ফেরাতে কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। কারণ গণঅভ্যুত্থানের পর জনগণ যে নতুন নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখেছিল, সেটি ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এনসিপি যেভাবে জন্ম নিয়েছিল—জনআকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের স্লোগান নিয়ে—সেটি ছিল ঐতিহাসিক। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে দলটির নেতাদের বিরুদ্ধে বারবার দুর্নীতি ও বিলাসিতার অভিযোগ ওঠা দলের প্রতি জনআস্থা দুর্বল করছে। তাদের মতে, যদি এনসিপি এই অবস্থার পরিবর্তন করতে না পারে, তবে দলটি পুরনো রাজনীতির কোলাহলের মধ্যেই হারিয়ে যাবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আশার আলো হয়ে এসেছিল। কিন্তু শুরুর পথেই আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া থেকে শুরু করে সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ ও গাজী সালাউদ্দিন তানভীর—দলের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠে এসেছে। এসব অভিযোগ কেবল দলটির ভাবমূর্তি নষ্ট করছে না, বরং জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের যে স্বপ্ন জন্মেছিল তা ভেঙে দিচ্ছে।
রাজনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া এনসিপি যদি নিজেদের শুদ্ধ করতে না পারে, তবে নতুন রাজনীতির স্বপ্ন ধীরে ধীরে অতীতের পুনরাবৃত্তিতে পরিণত হবে। আর জনগণ আবারও হতাশ হবে নতুন নেতৃত্বের প্রতি।