নিজস্ব প্রতিনিধি
সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার থানার অন্তর্গত মনোরম ও ঐতিহ্যবাহী গ্রাম দুর্লভপুর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা এই শান্ত গ্রামের মানুষ ধর্মপ্রাণ ও নৈতিক জীবনের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। সেই ধারাবাহিকতায় গ্রামের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক অনন্য ইসলামী শিক্ষা কার্যক্রম, যেখানে কুরআন শিক্ষার পাশাপাশি জীবনের প্রতিটি দিক নিয়ে ইসলামী শিক্ষা প্রদান করা হয়।
ধর্মীয় শিক্ষার আলোকবর্তিকা
দুর্লভপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর থেকেই শুরু হয় কুরআন শিক্ষা ও তালীমের ক্লাস। গ্রামের শিশুরা এখানে কুরআনের সঠিক তেলাওয়াত, তাজবীদ এবং মৌলিক ইসলামি বিধিবিধান শিখে।
বয়স্কদের জন্য রয়েছে আলাদা তালীমের আয়োজন, যেখানে ইসলামের আলোকে দৈনন্দিন জীবনের আদর্শ আচরণ, নৈতিকতা, সততা ও মানবিকতার শিক্ষা প্রদান করা হয়।
এখানকার শিক্ষক ও আলেমরা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন যেন ধর্মীয় শিক্ষা শুধু তত্ত্বে সীমাবদ্ধ না থেকে মানুষের চরিত্র ও জীবনে প্রতিফলিত হয়।
দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের বাস্তব প্রয়োগ
এই তালীমের অন্যতম লক্ষ্য হলো ইসলামি শিক্ষাকে জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া। শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় কিভাবে একজন মুসলমান হিসেবে পরিবার, সমাজ ও পেশাগত জীবনে দায়িত্বশীল হওয়া যায়।
শিক্ষার বিষয়বস্তুগুলোর মধ্যে রয়েছে—
এই বাস্তবমুখী শিক্ষার ফলে দুর্লভপুরে ইসলাম শুধু নামাজ-রোযার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে জীবনযাত্রার প্রতিটি অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়েছে।
মহিলা শিক্ষার আলাদা ব্যবস্থা: এক ইতিবাচক পরিবর্তন
দুর্লভপুর মসজিদভিত্তিক শিক্ষার সবচেয়ে প্রশংসনীয় দিক হলো মহিলাদের জন্য আলাদা তালীমের ব্যবস্থা। নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুযায়ী নারীদের জন্য কুরআন শিক্ষা ও ইসলামী দিকনির্দেশনা ক্লাস পরিচালিত হয়।
মহিলা শিক্ষক ও আলেমাদের তত্ত্বাবধানে এই ক্লাসে অংশ নেন গ্রামের বিভিন্ন বয়সের নারীরা।
তাদের শেখানো হয়:
এই উদ্যোগের ফলে গ্রামের নারীরা ধর্মীয়ভাবে সচেতন হচ্ছেন এবং পরিবারের মধ্যেও ইসলামী পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।
প্রবাসীদের অবদান ও সহযোগিতা
দুর্লভপুর গ্রামের উন্নয়ন ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারে প্রবাসে থাকা গ্রামের সন্তানদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে অবস্থানরত প্রবাসীরা নিয়মিতভাবে মসজিদ, মক্তব ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে আর্থিক সহায়তা পাঠাচ্ছেন।
তাদের অর্থায়নে মসজিদের সংস্কার, মক্তবের জন্য নতুন বই, শিক্ষার্থীদের পোশাক, পবিত্র রমজান মাসে ইফতার ও দান-খয়রাতের আয়োজন করা হয়।
গ্রামবাসীরা বলেন,
“আমাদের প্রবাসী ভাইয়েরা শুধু অর্থ পাঠান না, তাঁরা গ্রামের প্রতিটি কল্যাণমূলক কাজে হৃদয়ের টান নিয়ে অংশ নেন।”
এই প্রবাসী সহায়তা দুর্লভপুরকে আরও ঐক্যবদ্ধ ও আত্মনির্ভরশীল করে তুলেছে।
যুব সমাজের ঐক্য: ইউনাইটেড ক্লাবের ভূমিকা
গ্রামের তরুণদের উদ্যোগে গঠিত “ইউনাইটেড ক্লাব” দুর্লভপুরের সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
এই ক্লাবের সদস্যরা নিয়মিত মসজিদের তালীমে সহযোগিতা করে, সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে অংশ নেয় এবং মসজিদ ও গ্রামের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় কাজ করে।
তারা বিভিন্ন সময়ে রক্তদান কর্মসূচি, অসহায় পরিবারে খাদ্য বিতরণ, কোরআন প্রতিযোগিতা ও ইসলামিক কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে।
এছাড়া মসজিদের কোনো কাজ বা মক্তবের কার্যক্রমে সহযোগিতা প্রয়োজন হলে ইউনাইটেড ক্লাবের সদস্যরা সবার আগে এগিয়ে আসে।
দুর্লভপুর গ্রামের সামাজিক সংস্কৃতিতে রয়েছে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
গ্রামের বড়রা ছোটদের প্রতি দয়া ও মায়া দেখান, আবার তরুণ প্রজন্মও মুরুব্বিদের প্রতি গভীর সম্মান ও আনুগত্য প্রকাশ করে।
এ সম্পর্কের বন্ধন গ্রামটিকে একটি পরিবারের মতো করে রেখেছে।
গ্রামের মুরুব্বিদের কেউ অসুস্থ হলে তরুণরা খোঁজখবর নেয়, কেউ অসহায় হলে সবাই মিলে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়।
এই পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহযোগিতাই দুর্লভপুরকে অন্যান্য গ্রামের তুলনায় বিশেষভাবে আলাদা করেছে।
সমাজে নৈতিক পরিবর্তন ও ঐক্যবোধ
দুর্লভপুরের এই উদ্যোগে সমাজে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। তরুণরা নিয়মিত মসজিদে আসে, নামাজে অংশ নেয় এবং কুরআন শিক্ষায় আগ্রহী হয়।
পরিবার ও প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্ক উন্নত হয়েছে, সামাজিক দ্বন্দ্ব কমে এসেছে। মানুষ এখন বিরোধ মীমাংসা করে ইসলামি পদ্ধতিতে, শান্তিপূর্ণভাবে।
শিক্ষক ও স্থানীয় নেতৃত্বের অবদান
এই তালীম সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে গ্রামের মসজিদের ইমাম, মক্তব শিক্ষক ও স্থানীয় সমাজসেবীদের আন্তরিকতায়।
গ্রামের যুব সমাজও মসজিদভিত্তিক কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় ইসলামী শিক্ষা প্রচার করে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করছে।
এছাড়া মসজিদ পরিচালনা কমিটি নিয়মিত তহবিল সংগ্রহের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রেখেছে। এতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় বই, উপকরণ ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
ইসলামী শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিক সমাজ গঠন
দুর্লভপুরের মসজিদভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা আজ একটি সফল দৃষ্টান্ত। ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি এটি সমাজে নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ ও মানবিকতার চেতনা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
এই উদ্যোগ প্রমাণ করেছে— মসজিদ কেবল নামাজের স্থান নয়, বরং সমাজ গঠনের কেন্দ্রবিন্দু।
যদি দেশের প্রতিটি গ্রামে এভাবে মসজিদভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়, তবে সমাজে অবক্ষয় কমবে, মানুষ হবে ধর্মপ্রাণ, নৈতিক ও সচেতন।
দুর্লভপুর গ্রামের এই উদ্যোগ বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে এক আলোকিত উদাহরণ। এখানে কুরআন শিক্ষা, নৈতিকতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, প্রবাসীদের সহায়তা এবং যুব সমাজের অংশগ্রহণ— সবকিছু মিলিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ইসলামী চেতনায় সমৃদ্ধ এক আদর্শ গ্রাম।
এই মসজিদ ও এর তালীম কার্যক্রম প্রমাণ করছে যে—
ইসলাম শুধু ধর্ম নয়, এটি এক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষকে শান্তি, ভালোবাসা ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করে।