সম্পাদক: মুহাম্মদ জাকির হোসাইন
গত এক মাসে বাংলাদেশে যে তিনটি অপরাধশ্রেণী সবচেয়ে বেশি জনবিব্রত ও ভুক্তভোগী-সংকট সৃষ্টি করেছে — তারা হলো: হত্যা, ধর্ষণ ও চাঁদাবাজি। উদ্যোগী সাংবাদিক, মানবাধিকার সংস্থা ও পুলিশ রিপোর্টগুলো জানান, এসব অপরাধের মাত্রা এবং প্রকৃতি শুধুমাত্র পরিসংখ্যানিক বৃদ্ধি নয়; তা সামাজিক-রাজনৈতিক প্রকৃতিরও এক প্রতিবেদন — যেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক চাপে ভর্তসনা, এবং আইন প্রয়োগে ফাঁকফোকর একসঙ্গে কাজ করছে। সাম্প্রতিক সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা গাজীপুরে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনের নির্মম হত্যাকাণ্ড — যাকে তদন্তকারী সংস্থা ‘হানি-ট্র্যাপ’ ও চাঁদাবাজি-সংক্রান্ত একটি গ্যাং-কর্মের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছে। এ ঘটনার তদন্ত, গ্রেপ্তার এবং চার্জশিট-সংক্রান্ত অগ্রগতিই দেশের অপরাধ-চিত্র ও বিচারব্যবস্থার দক্ষতার দ্রুত একটি পরীক্ষণমঞ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিসংখ্যান: কী বলছে ?
সরকারী বা স্বাধীন তদন্তসংস্থাগুলোর সাম্প্রতিক প্রকাশিত তথ্য ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, ধর্ষণের ব্যাপকতা এবং সহিংস অপরাধেরূপের বৃদ্ধি সবচেয়ে লক্ষণীয় — বিশেষত নাবালিকা ও কিশোরী ভুক্তভোগীদের অংশগ্রহণ। এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি ক্ষমতাবদলের প্রথম নয় মাসে ৪,২৯৩টি ধর্ষণ মামলা দায়ের হয়েছে, এবং নারী-বিষয়ক সহিংসতার সামগ্রিক পরিসংখ্যানও শীর্ষস্থানীয় উদ্বেগের। তৎসঙ্গে, মানবাধিকার ও জাতীয় আন্তর্জাতিক রিপোর্টগুলো জানাচ্ছে যে ২০২৪-২৫-এর সময়ে নারী ও কন্যাশিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বেড়েছে; ২০২০–২৪ সময়ে প্রায় ৬,৩০৫টি ধর্ষণের ঘটনা নিবন্ধিত হয়েছে এবং বেশিরভাগ ভুক্তভোগীই ছিলেন ১৮ বছরের নিচে।
অপরদিকে, হত্যাকাণ্ড ও গোত্রভিত্তিক বা রাজনৈতিক সহিংসতায় মব-লিঞ্চিং-ধাঁচের মারাত্মক বৃদ্ধি নিরীক্ষণ করা হয়েছে বিভিন্ন স্বাধীন রিপোর্টে আগস্ট ২০২৪ থেকে চলতি সময় পর্যন্ত ৬০০-র বেশি মব-হত্যার ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে। এই সংখ্যা দেশের জননিরাপত্তা খাতের জন্য একটি দগদগে সতর্কবার্তা।
চাঁদাবাজি-সংক্রান্ত মামলা এবং রাজনৈতিক/ছাত্র সংগঠন বা অপরাধী গ্যাং-সংযুক্ততার অভিযোগও সাম্প্রতিক সময়ে বারবার সংবাদ শিরোনামে এসেছে — শুধুমাত্র বড় শহরেই নয়, জেলাতে-জেলাতে বাণিজ্যিক কেন্দ্র ও ট্রান্সপোর্ট নোডগুলোতেও চাঁদা দাবি ও হুমকির ঘটনা বেড়েছে; এতে ব্যবসা ও শ্রমজীবী জনগণের ওপর আর্থিক ও মানসিক প্রভাব গভীর।
ঘটনার নিবিড় চিত্র: কয়েকটি আলোচিত কেস স্টাডি
গাজীপুরে সাংবাদিক তুহিনের হত্যা — ভিডিও নেয়ার ‘পরিণতি‘
গাজীপুরে ফিল্ড রিরোপ্টিং করছিলেন সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন; তিনি এক জায়গায় হানি-ট্র্যাপ/চাঁদাবাজি সংক্রান্ত অনিয়ম-রেকর্ড করতে গিয়েছিলেন বলে জানতে পারে পুলিশ। সিসিটিভি বিশ্লেষণ ও মোবাইল ফরেনসিক সূত্রে তদন্তকারীরা আড়াই-চারজনকে শনাক্ত করেছেন; দ্রুত অভিযান করে সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং মোট আট জনের সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জিএমপি কমিশনার জানিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে পুলিশ জানান, আসামিরা ভিডিও মুছে ফেলার জন্য চাপ দিলে তুহিন অস্বীকার করেন; এরপর তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়। তদন্তের অগ্রগতি দেরিতে নয়—চলতি রিপোর্টে বলা হয়েছে চার্জশিট ১৫ দিনের মধ্যে দাখিল করা হবে। এই কেসটি সাংবাদিক নিরাপত্তা, ছোট-স্কেল চাঁদাবাজি ও স্থানীয় অপরাধ-গ্যাং-কার্যের সঙ্গে কীভাবে সাংবাদিকতা সংঘর্ষে পড়ে তা স্পষ্ট করে।
জেলাভিত্তিক ও শহুরে চাঁদাবাজি — ছাত্র এবং দলীয় বিবেচনা
গত কয়েক সপ্তাহে শহর এলাকাগুলোতে বিশেষ করে ছাত্র সংগঠনকে নিয়ে আশঙ্কাজনক অভিযোগ উঠেছে। ঢাকার কিছু মহকুমায় ছাত্র সংযুক্তদের বিরুদ্ধে পুরনো-নতুন অভিযোগে গ্রেপ্তারবৃত্তি ঘটেছে; উদাহরণসরূপ- টাঙ্গাইলে এক মাছ ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা দাবি ও হুমকির ঘটনায় তিনজন বিএনপি নেতা সহ পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে — এধরণের ঘটনা রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও স্থানীয় তত্ত্বাবধানে চাঁদাবাজির একটি মাত্র তালিকাভুক্ত কেস। আরেকদিকে গুলশানে প্রভাবশালী কেউকে লক্ষ্য করে টাকার দাবির ঘটনা এবং গ্রেপ্তারও হয়েছে — এসব ঘটনায় স্থানীয় দলের নেতা-কর্মীদের নামও সংবাদে এসেছে এবং দলের শীর্ষ নেতারা প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। এই হাজার-হাজার রুটিন-ঘটনার কিউমুলেটিভ প্রভাব স্থানীয় ব্যবসা ও জনজীবনে ব্যাপক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে।
গণধর্ষণ ও ভিডিওপ্রচারের ভয়াবহতা
সাম্প্রতিক দিনগুলোর আরেকটি সমস্যা হচ্ছে ধর্ষণের ঘটনাকে দ্রুত ভিডিও করে সামাজিক মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া — এতে ভুক্তভোগীর নিরাপত্তা ও মানহানি বহুগুণে বাড়ে। কিছু মামলায় দ্রুত গ্রেপ্তার হলেও দেখা গেছে যে বিচার প্রক্রিয়া, সাক্ষী-সুরক্ষা এবং ভুক্তভোগীর মানসিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা অনেক সময় অপর্যাপ্ত থাকে; ফলে পরিবার ও সমাজে পুনরায় সংঘাত দেখা দেয়। এই ধরনের ঘটনাগুলি শুধু অশান্তি নয়, জনগণের বিচারবোধে গভীর আঘাত ও অনাস্থা তৈরি করে।
কেন এমন হলো? কারণ-বিশ্লেষণ
অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও কর্মসংস্থান সংকট
দীর্ঘস্থায়ী বেকারত্ব, মজুরির অনিশ্চয়তা ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির ফলে অপরাধে প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি কোনো রহস্য নয়। গার্মেন্টস-শ্রমিক, গভর্নমেন্ট-চাকরিপ্রার্থী বা স্বল্পগ্রামীন উদ্যোক্তাদের আর্থিক চাপ অনেক ক্ষেত্রে প্রতিহিংসা ও অপরাধের পথকে ত্বরান্বিত করে। দরিদ্র ও উপকৃত শ্রেণীর মধ্যে অপরাধ-আচরণকে ‘জীবিকা’ হিসেবে দেখা যেতে পারে; আবার অনেকে রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ছায়ায় অপরাধকে পেশা হিসেবে নেয়। অর্থনৈতিক চাপ ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার এই সংমিশ্রণ অপরাধ প্রবণতাকে ত্বরানিত করে।
রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও সংগঠিত অপরাধ
সংঘটিত বহুলসংখ্যক মামলা থেকে দেখা যায় যে কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংগঠন ও ছাত্র-শাখার নাম জড়িয়ে যায় — যারা নিজেকে ‘নিয়মতান্ত্রিক’ শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করে এবং স্থানীয় স্তরে চাঁদাবাজি ও হয়রানি চালায়। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ক্ষমতার অভাব স্থানীয় নকশায় অপরাধীদের আশ্রয় দেয়। এছাড়া, রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সগ্রাহ্যতা দুর্বল হলে গ্যাং-কর্ম বেড়ে যায়; এটাই গত বছরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং চলতি সময়ের সংঘর্ষের একটি অন্যতম ব্যাখ্যা।
বিচারহীনতা ও সমাজিক শাস্তির অভাব
অপরাধী দ্রুত শাস্তি না পেলেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হিসেবে ‘মব-জাস্টিস’ বা গণপিটুনি-ধাঁচের উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় — যেখানে আনা-ঘটা ছাড়াই জনতা নিজে-নিজে বিচারের ষড়যন্ত্রে নেমে পড়ে। স্বাধীন ও স্বচ্ছ বিচার ব্যবস্থা না থাকলে সমাজের মানুষের মধ্যে বিচারহীনতার অভিজ্ঞতা জন্মায়, যা পরোক্ষভাবে আরও ভয়ানক অপরাধকে উস্কে দেয়। সাম্প্রতিক একাধিক রিপোর্টে উল্লেখিত মব-লিঞ্চিং সংখ্যা এমন অনাস্থারই প্রতিফলন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচারপ্রক্রিয়ার চ্যালেঞ্জসমূহ
তদন্ত ও দ্রুত চার্জশিট-প্রক্রিয়া
গাজীপুর মামলার মতো ক্ষেত্রে তদন্ত ত্বরান্বিত হয়েছে — তবে সারাদেশে সব মামলায় এমন দ্রুততা লক্ষ্য করা যায় না। অনেক অপরাধ মামলার চার্জশিট জমা পড়া বা বিচারের গতি অত্যন্ত ধীর; কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সাক্ষীর ভয়, ফরেনসিক সক্ষমতার ঘাটতি, কোর্ট-ব্যস্ততা এবং রাজনৈতিক সারণি। অফিসিয়াল সূত্রে বলা হয়েছে তুহিন মামলায় চার্জশিট ১৫ দিনের মধ্যে আনা হবে, কিন্তু অন্যান্য সংবেদনশীল মামলাগুলোর ক্ষেত্রে তদন্ত স্থবির হওয়ার খবরও রয়েছে।
প্রযুক্তি ও ফরেনসিক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা
সিসিটিভি, মোবাইল-ফরেনসিক ও ডিজিটাল ডাটা-রিকভারি আজ অপরাধ তদন্তে নির্ধারণী। যেসব অংশে এ প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে, সেখানে ধরনগত প্রমাণ দ্রুত সংগ্রহ করা যায়; কিন্তু দেশজুড়ে ফরেনসিক ল্যাব, প্রশিক্ষিত কর্মী ও পরীক্ষার স্পষ্টতা বেড়েই উঠলে তদন্তের গতি বাড়বে। গাজীপুর কেসে সিসিটিভি-ফুটেজই প্রধান নিরীক্ষক প্রমাণ হিসেবে কাজ করেছে।
ভুক্তভোগী-সুরক্ষা ও সাক্ষী-রক্ষণাবেক্ষণ
ধর্ষণ ও চাঁদাবাজি মামলায় ভুক্তভোগীর পরিচয়-রক্ষার হাতিয়ার থাকা জরুরি; কিন্তু অনেক ভুক্তভোগী পুলিশে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে ভয় পান। হটলাইন, শেল্টার হোম, এবং আইনি সহায়তার সুসংগঠিত ব্যবস্থা না থাকায় বহু ব্যক্তি মামলা থেকে সরে যায়। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এই সিস্টেম তৈরি না হলে বিচারিক সফলতা সীমিত থাকবে।
ভুক্তভোগীদের কণ্ঠ — ক্ষতচিহ্ন ও পুনর্বাসনচ্যালেঞ্জ
ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির ভুক্তভোগীরা মানুষ; তাদের অপমান, মানসিক কষ্ট এবং আর্থিক ক্ষতি দীর্ঘমেয়াদি। সাংবাদিক তুহিনের হত্যার ক্ষেত্রে সহকর্মীদের চিৎকার ছিল — “তুহিন যাচ্ছিল হানি-ট্র্যাপ উন্মোচনে, তার জীবন নিয়েছে অপরাধীরা” — এবং একই রকম অনেক ভুক্তভোগীর বক্তব্য প্রকাশ্যে এসেছে, যারা বিচার ও নিরাপত্তার দাবিতে সোচ্চার। মানবাধিকার সংস্থা ও স্থানীয় অধিকারকর্মীরা বলছেন, নির্যাতিতাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও আইনি সহায়তা দ্রুত ও সহজলভ্য করতে হবে।
আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় প্রতিক্রিয়া — মিডিয়া, সংগঠন ও রাজনীতি
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলো সাম্প্রতিক ঘটনার ওপর গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতারা কেসগুলোকে নিয়ে সরাসরি প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন; কিছু স্থানে গ্রেপ্তার ও রিমান্ড নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রত্যাশিতভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনগুলো বলছে — দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মানবাধিকার সংক্রান্ত উদ্বেগের প্রেক্ষিতে বিচারপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা অত্যন্ত জরুরি।
গত এক মাসের ঘটনা দেখাল যে হত্যা, ধর্ষণ ও চাঁদাবাজি কেবল অপরাধ নয়; তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক বিসংগতি, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বিচারব্যবস্থার ফাঁকফোকরের ফল। গাজীপুরের তুহিন হত্যা থেকে শুরু করে গ্রামীণ ও শহুরে চাঁদাবাজির কেস — সব কিছুর ভেতরেই একটি সাধারণ বার্তা রয়েছে: যতক্ষণ না বিচার দ্রুত ও স্বচ্ছ হচ্ছে, ততক্ষণ অপরাধের পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা যাবে না। রাষ্ট্র, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল ও সাধারণ নাগরিক—সবাইকে সমন্বিতভাবে দায়িত্ব নিতে হবে। দ্রুত ফরেনসিক সমর্থন, ভুক্তভোগী সুরক্ষা, এবং রাজনৈতিক-স্থানীয় কনসেন্সাস ছাড়া দেশের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা কঠিন হবে। সময়ের দাবি—শুধু অভিযোগ নয়; প্রমাণভিত্তিক তদন্ত, দ্রুত আদালত এবং ভুক্তভোগীর হাতে ত্বরিত ন্যায় প্রদান।
Leave a Reply