সম্পাদক: মুহাম্মদ জাকির হোসাইন
দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ—ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান—ঐতিহাসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে অভিন্ন সূত্রে গাঁথা। তবুও শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে তিন দেশের অগ্রগতির চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক শিক্ষা সূচক, উচ্চশিক্ষা র্যাঙ্কিং ও উদ্ভাবন সূচকগুলো স্পষ্ট করে দেখাচ্ছে, ভারত এখন এই অঞ্চলের নেতৃত্বে; আর বাংলাদেশ ও পাকিস্তান পিছিয়ে রয়েছে মান, কাঠামো ও গবেষণার পরিসরে। প্রশ্ন হলো, কেন ভারত এগিয়ে, আর আমাদের পিছিয়ে থাকা কোথায়?
ভারতের শিক্ষা অগ্রযাত্রার মূল শক্তি তাদের নীতিনির্ধারণের ধারাবাহিকতা। ১৯৮৬ সালের “ন্যাশনাল পলিসি অন এডুকেশন” থেকে শুরু করে ২০২০ সালের “ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি (NEP)”—প্রতিটি নীতিতেই তারা সময়োপযোগী সংস্কার ও প্রযুক্তি-ভিত্তিক শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছে। NEP ২০২০-এর মূল লক্ষ্য—“Education for All, Employment for All”—শুধু প্রাথমিক শিক্ষায় নয়, উচ্চশিক্ষা ও কারিগরি খাতেও প্রতিফলিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে একাধিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন হলেও বাস্তবায়নে ধারাবাহিকতা নেই। রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে নীতির গতি থেমে যায়, ফলে শিক্ষা ব্যবস্থা কখনো পরীক্ষানির্ভর, কখনো দক্ষতানির্ভর—এই দোলাচলে পড়ে গেছে। পাকিস্তানে ধর্মীয় বনাম আধুনিক শিক্ষার দ্বন্দ্ব আজও সমাধান হয়নি, যা একক রূপরেখার পথে বাধা।
শিক্ষা বাজেট কোনো দেশের অগ্রাধিকারের প্রতিফলন। ভারতে জিডিপির গড়ে ৪.৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় হয়, যার বড় অংশ গবেষণা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় বরাদ্দ। দেশটিতে সরকার ছাড়াও বেসরকারি ও করপোরেট খাত ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। ভারতের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো—IIT, IISc, IIM—শুধু রাষ্ট্রীয় নয়, বৈশ্বিক অর্থায়নেও পরিচালিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে শিক্ষা বাজেট জিডিপির মাত্র ২-২.৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ, জনসংখ্যার তুলনায় শিক্ষায় বিনিয়োগ অপ্রতুল। ফলে মানসম্পন্ন শিক্ষক তৈরি, গবেষণা অনুদান, ল্যাবরেটরি বা কারিগরি প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে তহবিল ঘাটতি প্রকট।
ভারতের প্রতিটি রাজ্যে শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য আলাদা কাউন্সিল ও ইনস্টিটিউট রয়েছে। UGC ও NCERT-এর অধীনে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও পাঠ্যসূচি উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। তাছাড়া, “Teacher Eligibility Test (TET)” বাধ্যতামূলক হওয়ায় শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতা নিশ্চিত হয়।
বাংলাদেশে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থাকলেও, সেগুলোর আপডেট ও আধুনিকীকরণ খুব ধীরগতির। প্রশিক্ষণের পরিধি সীমিত এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়াও অনিয়মিত। পাকিস্তানে এই ব্যবস্থার ভাঙন আরও প্রকট; বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলে শিক্ষক সংকট ও প্রশিক্ষণহীনতার হার উদ্বেগজনক।
ভারত ২০০০ সালের শুরুর দিকেই “ডিজিটাল ইন্ডিয়া” উদ্যোগের অংশ হিসেবে শিক্ষা খাতে প্রযুক্তি সংযোজন শুরু করে। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম যেমন—SWAYAM, NPTEL, e-PG Pathshala—দেশজুড়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তৈরি করেছে। এমনকি গ্রামীণ স্কুলগুলোতেও স্মার্ট ক্লাসরুম চালু হচ্ছে।
বাংলাদেশে “ডিজিটাল বাংলাদেশ” উদ্যোগে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এলেও, শিক্ষাখাতে প্রযুক্তির ব্যবহার এখনো নগরকেন্দ্রিক। অনলাইন শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম তৈরি হলেও তা মান, কনটেন্ট ও শিক্ষক দক্ষতার ঘাটতিতে ভুগছে। পাকিস্তানে ইন্টারনেট সংযোগের সীমাবদ্ধতা শিক্ষায় ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে জায়গা করে নিচ্ছে—IIT Bombay, IISc Bangalore, Delhi University নিয়মিত QS ও Times Higher Education তালিকায় অবস্থান করছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, যৌথ গবেষণা, বিদেশি শিক্ষক-ছাত্র বিনিময় । সব মিলিয়ে বৈশ্বিক শিক্ষা পরিবেশের সঙ্গে সংযুক্তি তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সীমিত। গবেষণার পরিমাণ ও মান দুটোই কম; অধিকাংশ গবেষণা তহবিলনির্ভর এবং শিল্প-শিক্ষা সংযোগ দুর্বল। ফলে গবেষণার ফল সামাজিক বা অর্থনৈতিক উন্নয়নে কার্যকরভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না।
ভারত কারিগরি শিক্ষাকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করেছে। “Skill India”, “Make in India” প্রভৃতি কর্মসূচির মাধ্যমে কোটি তরুণকে দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই কারিগরি শিক্ষা বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার ধারণা এখনো ঐচ্ছিক। সামাজিকভাবে ‘কম মর্যাদাপূর্ণ’ ভাবনা থেকে অনেকে এ খাতে আসতে চান না। পাকিস্তানেও মাদরাসা ও সাধারণ শিক্ষার ব্যবধান কারিগরি শিক্ষাকে দুর্বল করে রেখেছে।
ভারতের শিক্ষা নীতিতে শিল্পক্ষেত্রের চাহিদা অনুযায়ী পাঠ্যসূচি নির্ধারণ করা হয়। প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডেটা সায়েন্স, বায়োটেকনোলজি—এসব খাতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রম নিয়মিত হালনাগাদ হচ্ছে।
বাংলাদেশে শিক্ষাক্রমে এখনো তাত্ত্বিক জ্ঞানের প্রাধান্য বেশি; দক্ষতা বা উদ্যোক্তা তৈরির শিক্ষা সীমিত। ফলে শিক্ষিত বেকারত্ব বাড়ছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি অনুরূপ—শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মধ্যে সংযোগ দুর্বল।
ভারতের শিক্ষা খাত রাজনৈতিক দলীয় পরিবর্তনের পরও একটি ‘জাতীয় অগ্রাধিকার’ হিসেবে বিবেচিত। রাজ্যভেদে পার্থক্য থাকলেও মূল কাঠামো স্থিতিশীল।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে শিক্ষানীতির সঙ্গে রাজনৈতিক দলীয় প্রভাব গভীরভাবে জড়িত। নীতির পরিবর্তন, পাঠ্যবই বিতর্ক, নিয়োগে অনিয়ম—এসবই দীর্ঘমেয়াদি মানোন্নয়নে প্রতিবন্ধক।
ভারতে পরিবার ও সমাজে শিক্ষাকে বিনিয়োগ হিসেবে দেখা হয়। বিশেষত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও ইংরেজি শিক্ষায় আগ্রহ প্রবল। এমনকি নিম্নবিত্ত পরিবারও সন্তানকে শিক্ষিত করার জন্য ত্যাগ স্বীকারে আগ্রহী।
বাংলাদেশে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ থাকলেও মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রতি সচেতনতা এখনো সীমিত। পরীক্ষাভিত্তিক সাফল্যকেই সাফল্যের মাপকাঠি ধরা হয়। পাকিস্তানে ধর্মীয় ও সামাজিক দ্বন্দ্ব শিক্ষার আধুনিকীকরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
ভারত সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে বৈশ্বিক মানে উন্নীত করেছে। তাদের শিক্ষার্থীরা বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও চাকরিক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে।
বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি শিক্ষার্থীরাও মেধাবী, তবে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে দক্ষতার অভাবে পিছিয়ে পড়ছে। ভাষা দক্ষতা, গবেষণা পদ্ধতি, সমালোচনামূলক চিন্তা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা—এসব জায়গায় ঘাটতি রয়ে গেছে।
সমাধানের পথ: আমাদের করণীয়
১. নীতির ধারাবাহিকতা: রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, বাস্তবভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
২. বাজেট বৃদ্ধি: জিডিপির অন্তত ৪-৫ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ করে তা যথাযথ খাতে ব্যবহার জরুরি।
৩. শিক্ষক মানোন্নয়ন: বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ ও যোগ্যতা যাচাইয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪. গবেষণা তহবিল: বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সরকারি ও বেসরকারি অর্থায়ন বাড়ানো দরকার।
৫. কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণ: দক্ষতা উন্নয়ন ও উদ্যোক্তা তৈরিতে কারিগরি শিক্ষাকে মূলধারায় আনতে হবে।
৬. প্রযুক্তি সংযোজন: শহর ও গ্রামের বৈষম্য দূর করে সবার জন্য ডিজিটাল শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
ভারতের শিক্ষা অগ্রগতি কোনো একদিনের সাফল্য নয়; এটি দীর্ঘ পরিকল্পনা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সামাজিক সচেতনতার ফল। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান যদি নিজেদের ভবিষ্যৎকে শক্তিশালী করতে চায়, তবে শিক্ষাকে কেবল পরীক্ষার মাধ্যম নয়, মানবসম্পদ উন্নয়নের কৌশল হিসেবে দেখতে হবে।
শিক্ষায় বিনিয়োগ মানে ভবিষ্যতে বিনিয়োগ। ভারতের অগ্রগতির গল্প আমাদের শেখায়—নীতির ধারাবাহিকতা, গবেষণা ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। এখন প্রয়োজন সাহসী সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার।