1. desherchitrabd@gmail.com : Desher DesherChitra : Desher Chitra
সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ০৪:০০ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম :

স্বাধীনতার পর থেকে ২০২৫ পর্যন্ত বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা ও অপরাধ: দুর্নীতি, নিপীড়ন ও গণতন্ত্রহীনতার এক করুণ খতিয়ান

  • আপডেট টাইম : বুধবার, ৪ জুন, ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অর্ধশতক পার করেছে। এ দীর্ঘ সময়ে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে—কখনো সামরিক শাসনে, কখনো দলীয় স্বার্থে গৃহীত ‘গণতন্ত্রের মুখোশধারী’ শাসনব্যবস্থায়। এ প্রতিবেদনে ১৯৭১ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সকল সরকারের শাসনামলে সংঘটিত দুর্নীতি, জঙ্গি উত্থান, সংখ্যালঘু নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আইনশৃঙ্খলার চিত্র তুলে ধরা হলো।

বঙ্গবন্ধু থেকে বাকশাল (১৯৭২–১৯৭৫)

স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নতুন বাংলাদেশ গড়ার অভিযাত্রায় নেমেছিল। তবে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ, ত্রাণ বণ্টনে দুর্নীতি, সরকারি প্রশাসনে অদক্ষতা এবং বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একদলীয় শাসনব্যবস্থা গণতন্ত্রের অপমৃত্যুর সূচনা করে। সংবাদপত্র বন্ধ, বিরোধীদের দমন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ ছিল উল্লেখযোগ্য।

সামরিক অভ্যুত্থান ও স্বৈরশাসন (১৯৭৫–১৯৯০)

জিয়াউর রহমান (১৯৭৫–১৯৮১)

১৯৭৭ সালের বিমান বাহিনীর বিদ্রোহ দমনকালে শতাধিক সেনাসদস্যকে বিচারহীনভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়।
রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক দল পুনর্বহাল করে জঙ্গি মতবাদের ভিত্তি রচনা হয়।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ (১৯৮২–১৯৯০)

দুর্নীতিতে বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে থাকা, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা, এবং বিরোধী দল ও মিডিয়াকে দমন এই সময়ের বৈশিষ্ট্য।
সাংবাদিকদের গ্রেফতার, সেনাবাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সংখ্যালঘুদের জমি দখলের ঘটনার অভিযোগ রয়েছে।

গণতন্ত্রের পুনরাবির্ভাব, কিন্তু স্থিতিশীলতা অনুপস্থিত (১৯৯১–২০০6)

খালেদা জিয়া (১৯৯১–১৯৯৬, ২০০১–২০০৬)

এই সময়ে দুর্নীতি রাষ্ট্রীয় নীতি হয়ে দাঁড়ায়।
বিশ্বব্যাংক একাধিকবার বাংলাদেশকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ বলে ঘোষণা করে।
২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা এবং ২০০৫ সালে দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলায় জঙ্গিদের ক্ষমতাবান হয়ে ওঠা স্পষ্ট হয়।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে ব্যাপক হামলা হয়।

শেখ হাসিনা (১৯৯৬–২০০১)

জোট সরকারের বিরুদ্ধে বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ, চট্টগ্রাম বন্দরে ঘুষ বাণিজ্য ও টেলিকম খাতে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়।
তবে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তখনও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ হয়নি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সেনা-নির্দেশিত সময়কাল (২০০৭–২০০৮)

সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে “ওয়ান ইলেভেন” ঘটনার মাধ্যমে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তাদেরকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
সেই সময় শেখ হাসিনার দেশের বাইরে চলে যাওয়ার ঘটনা—যা একধরনের “পলায়ন” হিসেবেও আলোচিত—জনমনে প্রশ্ন তোলে।
একই সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঐ সময় রাজনীতিতে আসার ঘোষণা দিলে সেনা-সমর্থিত সরকার তাঁকে প্রধানমন্ত্রিত্বে বসানোর পরিকল্পনায় এগোয়—যদিও ব্যর্থ হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে র‍্যাব, সেনাবাহিনী ও পুলিশ মিলিয়ে প্রায় ৪০০ জন ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন বলে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য।

একদলীয় শাসনের দিকে অভিযাত্রা: আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা (২০০৯–২০২৫)

২০০৯–২০১৪

জঙ্গি দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিছু সাফল্য পেলেও বিচারবহির্ভূত হত্যার মাধ্যমে সরকার বিরোধীদের দমন করতে থাকে।
২০১৩ সালের হেফাজতের ‘জুলাই গণহত্যা’ নামে পরিচিত মতিঝিল অভিযানে শতাধিক মানুষ নিহত হয়—যদিও সরকার সংখ্যা অস্বীকার করে।
এই সময়েই পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন প্রত্যাহার করে নেয়।
রামুতে বৌদ্ধ বিহারে হামলা, পাবনায় হিন্দুদের বাড়িঘর ভাঙচুর সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার দুর্দশা তুলে ধরে।

২০১৪–২০১৮

২০১৪ সালের নির্বাচন বিরোধীদল বর্জন করলে ১৫৩টি আসনে বিনা ভোটে জয়লাভের নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে।
এ সময় থেকে কার্যত সংসদে বিরোধী কণ্ঠ নিস্পৃহ হয়ে পড়ে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাসের মাধ্যমে গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিপন্ন হয়।
২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিজান হামলায় জঙ্গিরা প্রমাণ করে—তাদের মূল শেকড় এখনো উপড়ানো হয়নি।

২০১৮–২০২৩

২০১৮ সালের নির্বাচনেও ভুয়া ভোট ও কেন্দ্র দখলের অভিযোগ উঠে।
বিচারবহির্ভূত গ্রেপ্তার, গুম, অপহরণ বাড়তে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালে র‍্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও রংপুরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।
সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের গ্রেপ্তার ও হুমকি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর সরকারের চাপের প্রমাণ।

২০২৪–২০২৫

২০২৪ সালের নির্বাচন আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বিরোধীদের কার্যত নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠে।
গণতন্ত্রের নামে নির্বাচন হলেও, রাজনৈতিক মতপ্রকাশে বাধা, সভা-সমাবেশে পুলিশের অনুমতি, এবং সামাজিক মাধ্যমে নজরদারির মাধ্যমে একধরনের ‘নির্বাচিত কর্তৃত্ববাদ’ কায়েম হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
সরকার মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও বাস্তবে গণতন্ত্রের ন্যূনতম উপাদানগুলো—বিরোধীদল, স্বাধীন বিচার বিভাগ ও মুক্ত মিডিয়া—বহুলাংশেই অনুপস্থিত।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বারবার ঘুরে দাঁড়ালেও গণতান্ত্রিক চর্চা, মানবাধিকার, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন এবং আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠা আজও অধরা।
দলীয় স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালনা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব—এসবই প্রমাণ করে, কথার গণতন্ত্র থাকলেও কার্যত গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটেছে বহু আগেই।
রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে জবাবদিহিতার অভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং দায়মুক্তির প্রবণতা আমাদের এগিয়ে নিতে নয়, বরং অন্ধকারের অতল গহ্বরে নিয়ে যাচ্ছে।

Share this Post in Your Social Media

এই ধরনের আরও খবর
Copyright © 2025, সাপ্তাহিক দেশের চিত্র. All rights reserved.
Weekly Desher Chitra developed by LogoMyface