লাইফস্টাইল ডেস্ক
মানবদেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো হৃদপিণ্ড। এটি আমাদের শরীরের প্রতিটি অংশে রক্ত, অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ করে। হৃদপিণ্ডের স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখতে দরকার সুনির্দিষ্ট বৈদ্যুতিক সিগন্যাল। কিন্তু কোনো কারণে যদি এই বৈদ্যুতিক সিগন্যাল চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়, তখন সেটিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় হার্ট ব্লক (Heart Block) বলা হয়।
হার্ট ব্লক সাধারণভাবে বলতে গেলে একটি হৃদরোগ, যেখানে হৃদপিণ্ডের বৈদ্যুতিক পরিবাহী সিস্টেমে বিঘ্ন ঘটে এবং হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক হয়ে যায়। অনেক সময় এটি সামান্য সমস্যা হয়ে থাকতে পারে, আবার অনেক সময় জীবনহানির কারণও হতে পারে। তাই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে জানা ও বোঝা প্রয়োজন।
হার্ট ব্লক কী?
হৃদপিণ্ডের ভেতরে একটি বিশেষ বৈদ্যুতিক পরিবাহী ব্যবস্থা আছে। সাইনোএট্রিয়াল (SA) নোড থেকে উৎপন্ন সংকেত প্রথমে এট্রিয়া বা হৃদপিণ্ডের উপরের প্রকোষ্ঠে যায়, তারপর এট্রিওভেন্ট্রিকুলার (AV) নোড হয়ে ভেন্ট্রিকলে পৌঁছে হৃদস্পন্দন সৃষ্টি করে।
যখন এই সংকেত AV নোড বা পরিবাহী পথে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখনই হার্ট ব্লক ঘটে। ফলে হৃদস্পন্দন ধীর হয়ে যায়, অনিয়মিত হয় বা কখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
হার্ট ব্লকের ধরন
চিকিৎসাবিজ্ঞানে হার্ট ব্লককে সাধারণত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়:
১. ফার্স্ট-ডিগ্রি হার্ট ব্লক (First-Degree Heart Block)
- বৈদ্যুতিক সিগন্যাল ভেন্ট্রিকলে পৌঁছাতে দেরি করে।
- সাধারণত এটি তেমন ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
- অনেক ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না।
২. সেকেন্ড-ডিগ্রি হার্ট ব্লক (Second-Degree Heart Block)
- এখানে কিছু বৈদ্যুতিক সিগন্যাল ভেন্ট্রিকলে পৌঁছাতে পারে না।
- এরও আবার দুই রকম ভাগ আছে:
- টাইপ I (Mobitz I / Wenckebach): ধীরে ধীরে সংকেত হারিয়ে যায়।
- টাইপ II (Mobitz II): হঠাৎ করে সংকেত বন্ধ হয়ে যায়, যা বেশি বিপজ্জনক।
৩. থার্ড-ডিগ্রি বা সম্পূর্ণ হার্ট ব্লক (Third-Degree / Complete Heart Block)
- কোনো বৈদ্যুতিক সিগন্যাল ভেন্ট্রিকলে পৌঁছায় না।
- হৃদপিণ্ড খুব ধীরে স্পন্দিত হয়।
- এটি জীবনঘাতী এবং জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
হার্ট ব্লকের কারণ
হার্ট ব্লক হওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে:
- জন্মগত ত্রুটি: কারও জন্মগতভাবে হৃদপিণ্ডের বৈদ্যুতিক সিস্টেমে সমস্যা থাকতে পারে।
- বার্ধক্য: বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে হৃদপিণ্ডের টিস্যু দুর্বল হয়ে যায়।
- হৃদরোগ: হার্ট অ্যাটাক, করোনারি আর্টারি ডিজিজ বা মায়োকার্ডাইটিস।
- সার্জারি: হৃদপিণ্ডে অপারেশন বা কৃত্রিম ভালভ প্রতিস্থাপন।
- ওষুধের প্রভাব: কিছু ওষুধ যেমন বিটা-ব্লকার, ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার ইত্যাদি।
- সংক্রমণ: লেইম রোগ, ডিফথেরিয়া প্রভৃতি সংক্রমণও কারণ হতে পারে।
- ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা: বিশেষত পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি।
হার্ট ব্লকের লক্ষণ
হার্ট ব্লকের ধরন ও তীব্রতার ওপর ভিত্তি করে লক্ষণ ভিন্ন হতে পারে।
- ফার্স্ট-ডিগ্রি হার্ট ব্লক: সাধারণত কোনো লক্ষণ থাকে না। রুটিন ইসিজি পরীক্ষায় ধরা পড়ে।
- সেকেন্ড-ডিগ্রি হার্ট ব্লক:
- মাথা ঘোরা
- বুক ধড়ফড় করা
- দুর্বলতা বা অবসাদ
- মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
- থার্ড-ডিগ্রি হার্ট ব্লক:
- ঘন ঘন অজ্ঞান হওয়া
- তীব্র শ্বাসকষ্ট
- বুকে ব্যথা
- অতিরিক্ত ক্লান্তি
- হৃদস্পন্দন খুব ধীর হওয়া (ব্র্যাডিকার্ডিয়া)
- হঠাৎ মৃত্যুঝুঁকি
হার্ট ব্লকের জটিলতা
হার্ট ব্লক অবহেলা করলে মারাত্মক জটিলতা হতে পারে:
- হার্ট ফেইলিউর
- আকস্মিক কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট
- স্ট্রোক
- জীবনহানি
তাই সামান্য উপসর্গও উপেক্ষা করা উচিত নয়।
হার্ট ব্লক শনাক্তকরণ
হার্ট ব্লক শনাক্ত করতে চিকিৎসক সাধারণত কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকেন:
- ইসিজি (ECG): সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা, যা বৈদ্যুতিক সিগন্যালের অসঙ্গতি দেখায়।
- হল্টার মনিটর: ২৪ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে হৃদস্পন্দন রেকর্ড করা হয়।
- ইকোকার্ডিওগ্রাম: হৃদপিণ্ডের গঠন ও কার্যকারিতা দেখা হয়।
- স্ট্রেস টেস্ট: ব্যায়ামের সময় হৃদস্পন্দনের পরিবর্তন পরীক্ষা করা হয়।
- রক্ত পরীক্ষা: সংক্রমণ বা ইলেক্ট্রোলাইটের অসামঞ্জস্য যাচাই।
হার্ট ব্লকের চিকিৎসা
হার্ট ব্লকের চিকিৎসা এর ধরন ও তীব্রতার ওপর নির্ভর করে।
১. হালকা হার্ট ব্লক (First-Degree)
- সাধারণত বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না।
- কেবল নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও জীবনধারায় পরিবর্তন।
২. সেকেন্ড-ডিগ্রি হার্ট ব্লক
- টাইপ I হলে পর্যবেক্ষণ করা হয়।
- টাইপ II হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পেসমেকার প্রয়োজন হয়।
৩. থার্ড-ডিগ্রি হার্ট ব্লক
- এটি জরুরি অবস্থা।
- দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।
- স্থায়ী সমাধান হিসেবে পেসমেকার প্রতিস্থাপন করা হয়।
৪. অন্যান্য চিকিৎসা
- ওষুধ পরিবর্তন (যদি ব্লক ওষুধজনিত হয়)।
- ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য ঠিক করা।
- মূল রোগের চিকিৎসা (যেমন সংক্রমণ বা হৃদরোগ)।
হার্ট ব্লক থেকে বাঁচার উপায়
যদিও সব ধরনের হার্ট ব্লক প্রতিরোধ করা সম্ভব নয় (বিশেষত জন্মগত বা বয়সজনিত), তবুও কিছু সচেতনতা মেনে চললে ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো যায়।
১. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন
- সুষম খাদ্যগ্রহণ: প্রচুর ফল, সবজি, মাছ ও আঁশযুক্ত খাবার।
- লবণ ও অতিরিক্ত চর্বি কম খাওয়া।
- অ্যালকোহল ও ধূমপান সম্পূর্ণ পরিহার করা।
২. নিয়মিত ব্যায়াম
- প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম।
- অতিরিক্ত পরিশ্রম এড়িয়ে চলা, বিশেষত যদি আগেই হৃদরোগ থাকে।
৩. ওজন নিয়ন্ত্রণ
- স্থূলতা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
- বিএমআই স্বাভাবিক সীমায় রাখা জরুরি।
৪. উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
- নিয়মিত রক্তচাপ ও শর্করা মাপা।
- চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়া।
৫. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা
- বছরে অন্তত একবার ইসিজি ও হার্ট চেকআপ।
- পারিবারিক ইতিহাস থাকলে আরও সতর্ক হওয়া।
৬. ওষুধ সেবনে সতর্কতা
- বিটা-ব্লকার, ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার ইত্যাদি ডাক্তার ছাড়া নিজে থেকে খাওয়া উচিত নয়।
৭. মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ
- অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা এড়িয়ে চলা।
- মেডিটেশন, নামাজ বা রিলাক্সেশন অনুশীলন করা।
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
যদি নিচের যেকোনো লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে:
- ঘন ঘন মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হওয়া।
- হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে ধীর বা দ্রুত হওয়া।
- বুক ধড়ফড় বা বুকে ব্যথা।
- তীব্র শ্বাসকষ্ট।
হার্ট ব্লক একটি গুরুত্বপূর্ণ হৃদরোগ, যা হালকা পর্যায় থেকে শুরু করে জীবন-সংহারক পর্যায় পর্যন্ত হতে পারে। এর লক্ষণ সবসময় স্পষ্ট না-ও হতে পারে, তাই সচেতনতা ও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা অত্যন্ত জরুরি।
সর্বোপরি মনে রাখতে হবে, প্রতিরোধই সেরা চিকিৎসা। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন, এবং নিয়মিত চেকআপ হার্ট ব্লকসহ অন্যান্য হৃদরোগ থেকে বাঁচার সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
Post Views:
81