সম্পাদক : মুহাম্মদ জাকির হোসাইন
বাংলাদেশে ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ৯২ শতাংশের কাছাকাছি। এই বাস্তবতায় প্রশ্ন ওঠে—এদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলসমূহ এখনো কেন জনগণের বড় অংশের সমর্থন পায় না? বিশেষত জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ , জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস—এদের কার্যক্রম, আদর্শ ও লক্ষ্য প্রায় একরকম হলেও তারা জাতীয় রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান গড়তে ব্যর্থ কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় কিছু ঐতিহাসিক, সাংগঠনিক, আদর্শিক ও মনস্তাত্ত্বিক বাধা চোখে পড়ে। আজকের এই সম্পাদকীয়তে আমরা এই দলগুলোর তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতার খতিয়ান তুলে ধরতে চাই।
ইতিহাসের ভারে নত জামায়াতে ইসলামী:
জামায়াতে ইসলামীর নাম আসলেই মানুষের মনে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পাকিস্তানপন্থী অবস্থানের কথা চলে আসে। তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতারা যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত হওয়ায় দলটির উপর এক গভীর ঐতিহাসিক ও নৈতিক সংকটের ছাপ রয়েছে। যদিও দলটি পরবর্তী সময়ে জনসংযোগ ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু অধিকাংশ সাধারণ ভোটারই সেই আস্থা ফিরিয়ে আনেননি।
সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াতের নিবন্ধন পুনর্বহাল হয়েছে। তারা রাজনৈতিক ময়দানে নতুনভাবে প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—কি আদলে তারা নিজেদের তুলে ধরবে? কেবল অতীত অস্বীকার করে নয়, বরং অতীতের ভুল স্বীকার করে নতুন রাজনৈতিক নৈতিকতার পথে না হাঁটলে এই দলের প্রতি জনগণের আস্থার সেতু আর গড়ে উঠবে না।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ:
সম্ভাবনার মাঝে সীমাবদ্ধতা। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে ‘নতুন’ দল। তারা যুদ্ধপরবর্তী ইতিহাসের দায়মুক্ত হওয়ায় সাধারণ মানুষ তাদের অনেকটাই ‘পরিষ্কার’ ভাবেন। তবে তারা এখনও শহরকেন্দ্রিক, ছোট সংগঠন হিসেবে বিবেচিত। তৃণমূলে জনপ্রিয়তা বাড়লেও জাতীয় ভোটে বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারেনি।
একটি মধ্যপন্থী ইসলামী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও, এখনও নেতৃত্বের দৃঢ়তা, যুবসমাজের অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক কৌশলের শানিত পরিকল্পনা নেই বলেই তারা বৃহৎ গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস: প্রান্তিক বলয়ে আটকে থাকা ধর্মীয় রাজনীতি,এই দুটি দল মূলত উলামা ও মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন। তারা অঞ্চলভিত্তিক কিছু প্রভাব রাখলেও, জাতীয় রাজনীতিতে কোনো কার্যকর প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি। তাদের রাজনৈতিক তৎপরতা অনেকাংশে আদর্শিক বক্তব্য আর মঞ্চকেন্দ্রিক আবেগে সীমাবদ্ধ।
নেতৃত্বের সংকট, গণমাধ্যমে কার্যকর উপস্থিতির অভাব, এবং নতুন প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকার কারণে এই দলগুলো সময়োপযোগী রাজনীতি গড়ে তুলতে পারেনি। সবচেয়ে বড় কথা, জনগণের মৌলিক সমস্যা—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ইত্যাদিতে তাদের সুদূরপ্রসারী কোনো বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা নেই।
সাধারণ সমস্যাগুলো যেগুলো সবাই ভাগ করে নিচ্ছে
সবকটি ইসলামী দলই ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় কিছু সমস্যা ভাগ করে নিচ্ছে:
সংগঠন ও জনসম্পর্ক দুর্বল: তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় কাঠামো গড়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়া।
নেতৃত্ব সংকট: আধুনিক, চিন্তাশীল, ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বের অনুপস্থিতি।
জনমুখী রাজনৈতিক বার্তার অভাব: ধর্মের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে রুটিন শ্লোগান ও প্রতিক্রিয়া।
ঐক্যহীনতা ও মতানৈক্য: ইসলামী দলগুলো নিজেদের মধ্যেই বিভাজিত, যার ফলে বৃহৎ জনভিত্তি তৈরির পথে তারা ব্যর্থ।
আধুনিক রাজনৈতিক কৌশলের ঘাটতি: সোশ্যাল মিডিয়া, রাজনৈতিক মার্কেটিং, নীতি-ভিত্তিক বিতর্কে অনুপস্থিতি।
সামনে এগোনোর পথ কি তাহলে ?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মীয় দলের জন্য স্পষ্ট একটি জনপ্রত্যাশা ভিত্তিক রোডম্যাপ তৈরি দরকার—যেখানে ধর্ম থাকবে, কিন্তু থাকবে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান, সুশাসনের বাস্তবপ্রতিশ্রুতি। এই দলগুলোকে স্বচ্ছ, আধুনিক, নৈতিক নেতৃত্ব ও গণমুখী রাজনীতির ভাষা শেখার সময় এসেছে।
একটি বাস্তবতা হলো—বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, কিন্তু অন্ধ নয়। তারা চায় এমন রাজনৈতিক নেতৃত্ব যারা ধর্মীয় অনুশাসনের সঙ্গে বাস্তব জীবন সমস্যা সমাধানের পথে সাহসী সিদ্ধান্ত নেবে। কেবল মঞ্চের বক্তব্য আর মুখস্ত স্লোগান দিয়ে মানুষের আস্থা অর্জন করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো আদর্শের দিক থেকে শক্তিশালী হলেও, বাস্তব রাজনীতির ময়দানে তারা এখনও অনেক পিছিয়ে। তারা যদি নিজেদের ভেতরের দুর্বলতা স্বীকার করে আধুনিক রাজনৈতিক কৌশল ও জনসম্পৃক্ততা অর্জনে আন্তরিক হয়, তবে ভবিষ্যতে একটি নৈতিক রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে জনগণের সামনে আসার সুযোগ তাদের রয়েছে।
আবার যদি অতীত ভুলে কেবল পুরোনো পন্থায় ফিরতে চায়—তবে তাদের ভবিষ্যৎও হবে অতীতের মতোই নিষ্প্রভ।
Leave a Reply