সম্পাদক: মুহাম্মদ জাকির হোসাইন
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। একদিকে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার অধিকার ও সুব্যবস্থার দাবিতে আন্দোলন করছেন, অন্যদিকে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক জটিলতা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও মানসম্মত শিক্ষাজীবনকে প্রভাবিত করছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া সংঘর্ষ, ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা, রাজনৈতিক নেতা ও গ্রুপের হস্তক্ষেপ এবং প্রশাসনের অনিশ্চিত পদক্ষেপ শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশকে ক্রমেই অস্থিতিশীল করে তুলছে।
শিক্ষাঙ্গনের মূল লক্ষ্য হলো জ্ঞান, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সমন্বয়ে এক সুস্থ ও জ্ঞানমুখী সমাজ গঠন করা। কিন্তু যখন শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক প্রভাব, মব আক্রমণ এবং প্রশাসনিক অব্যবস্থার শিকার হন, তখন শিক্ষাঙ্গনের মূল উদ্দেশ্য বিপন্ন হয়। শুধু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে নয়, সমাজের অন্যান্য অংশও এ অস্থিরতার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা একদিকে তাদের অধিকার রক্ষার চেষ্টা করছেন, অন্যদিকে অনিশ্চিত পরিস্থিতি তাদের সৃষ্টিশীলতা ও মনোবলকে হ্রাস করছে।
সাম্প্রতিক উদাহরণগুলো আমাদের সতর্কবার্তা দিচ্ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীদের ওপর ধারালো অস্ত্র ও লাঠি দিয়ে আক্রমণ, এমনকি নারী শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক হেনস্থা ইঙ্গিত করছে যে শিক্ষাঙ্গনে সংরক্ষিত নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা বর্তমানে যথেষ্ট সুনিশ্চিত নয়। একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও সন্ত্রাসের ঘটনায় দেখা যাচ্ছে যে, শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা এখন শুধু এক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয় নয়, এটি সমগ্র শিক্ষাক্ষেত্রকে প্রভাবিত করছে।
অবশ্যই, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও মত প্রকাশ শিক্ষাঙ্গনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটা তাদের নাগরিক চেতনা, ন্যায্য দাবি ও সমাজের পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু সমস্যার মূল বিষয় হলো, রাজনৈতিক দল ও ক্ষমতার খেলায় শিক্ষাঙ্গনকে ব্যবহার করা। ছাত্রলীগ, জাসাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শাখা শিক্ষার্থীরা প্রায়ই তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে শিক্ষাঙ্গনে হস্তক্ষেপ করে। এটি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ শিক্ষাজীবনকে হুমকির মুখে ফেলে।
প্রশাসনের ভূমিকা এখানেও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যখন যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়, তখন শিক্ষাঙ্গন আরও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। প্রশাসনিক অনিশ্চয়তা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে ভয়, অনিশ্চয়তা এবং হতাশা সৃষ্টি করে। এটি শুধু শিক্ষাঙ্গনের নয়, সমাজের জন্যও ক্ষতিকর। একজন শিক্ষার্থী যখন তার নিরাপত্তা ও অধিকার নিয়ে অনিশ্চয়তায় থাকে, তখন তার সৃজনশীলতা, শিক্ষা অর্জনের আগ্রহ ও সামাজিক সচেতনতা বাধাপ্রাপ্ত হয়।
শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতার আরেকটি কারণ হলো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মানদণ্ডের ব্যর্থতা। শিক্ষক, অভিভাবক ও সমাজের অন্যান্য অংশ শিক্ষার্থীদের উপর সমর্থন ও সুরক্ষা প্রদানে আরও সচেতন হতে হবে। শিক্ষার্থীরা নিরাপদ, সম্মানজনক ও স্বাধীন পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারলে তারা সমাজের দায়িত্বশীল নাগরিক হয়ে ওঠে। তবে, বর্তমানে শিক্ষাঙ্গনে হামলা, হেনস্থা ও মব-সন্ত্রাসের ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীরা ক্রমশ ভয়ভীতি ও মানসিক চাপের মধ্যে শিক্ষাজীবন চালাচ্ছেন।
এই পরিস্থিতিতে সমাধানের পথ হলো শিক্ষাঙ্গনকে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরাপত্তা, স্বচ্ছতা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা জরুরি। প্রশাসন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীসহ সকলকে একত্রে কাজ করতে হবে যাতে শিক্ষাঙ্গন সত্যিকার অর্থে শিক্ষার কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোকে শিক্ষাঙ্গনে হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপদ ও সৃজনশীল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
অবশেষে, শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা শুধুমাত্র শিক্ষার্থীর নয়, পুরো জাতির জন্য হুমকি। যদি আজকের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ ও স্বচ্ছ শিক্ষাজীবন থেকে বঞ্চিত হন, তবে আগামী প্রজন্মও তার নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারবে না। তাই শিক্ষাঙ্গনকে অস্থিরতা থেকে মুক্ত রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার—শিক্ষক, প্রশাসন, অভিভাবক, রাজনৈতিক দল ও সমাজকে মিলিতভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। শিক্ষাঙ্গন শান্তিপূর্ণ, সৃজনশীল ও নিরাপদ হলে সমাজও প্রগতিশীল ও স্থিতিশীল হবে।
শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা শুধু এক দিনের ঘটনা নয়; এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জ্ঞান ও মূল্যবোধের উপর প্রভাব ফেলে। তাই শিক্ষাঙ্গনকে শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও স্বাধীন রাখার জন্য সবার সচেতনতা, দায়িত্বশীলতা ও সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। এটি না হলে শিক্ষার মূল লক্ষ্য পূর্ণ হবে না, এবং আমাদের জাতির ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে যাবে।