অনলাইন ডেস্ক
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় ২০২৪ সালের শেষে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দীর্ঘদিন গোপন থাকা খেলাপি ঋণ ও ক্ষতির হিসাব প্রকাশ পাওয়ায় ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের হার (সিআরএআর) নেমে আসে মাত্র ৩ দশমিক ০৮ শতাংশে—যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত মানের অর্ধেকেরও কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৫৬ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৫৯ শতাংশ বেশি। দেশের ইতিহাসে এটিই সর্বোচ্চ। এই ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের অঙ্ক জাতীয় বাজেটের প্রায় সমান এবং মোট ঋণের প্রায় ৪৫ শতাংশ। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, পুনঃতফসিলকৃত ঋণ ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৪৬১ কোটি এবং অবলোপনকৃত ঋণ ৬২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
অন্যদিকে, ভারতে সিআরএআর ছিল ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ২০ দশমিক ৬ শতাংশ। এমনকি তুলনামূলক ছোট অর্থনীতির দেশ নেপাল, ভুটান ও আফগানিস্তানেও হার ১০ শতাংশের বেশি। আন্তর্জাতিক বেসেল-৩ মানদণ্ড অনুযায়ী প্রয়োজনীয় হার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ হলেও বাংলাদেশ তার ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারেনি।
মূলধন ঘাটতির সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোতে। ইসলামি ব্যাংকগুলোর সিআরএআর ২০২৩ সালে ১২ দশমিক ৭১ শতাংশ থাকলেও ২০২৪ সালে নেমে যায় ঋণাত্মক ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশে। সাতটি ইসলামি ব্যাংকের ব্যাপক ক্ষতি এ অবস্থার জন্য দায়ী।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, ‘সমস্যাটি কাঠামোগত। প্রথম প্রজন্মের ব্যাংক স্থাপনের সময় প্রাথমিক মূলধনের শর্ত ছিল মাত্র ৩ কোটি টাকা। অথচ আমানত ও ঋণের চাহিদা দ্রুত বেড়ে যায়। মূলধন বাড়াতে না পারায় ব্যাংকগুলো দুর্বল থেকে গেছে। জমার টাকাও কার্যত শেষ হয়ে গেছে।’
এদিকে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিস্থিতি আরও করুণ। তাদের খেলাপি ঋণের হার ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ দশমিক ৮৩ শতাংশে এবং সিআরএআর নেমে গেছে ঋণাত্মক ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ, মূলধনের ঘাটতি এবং সাইবার আক্রমণের ঝুঁকি কাটিয়ে উঠতে না পারলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত টেকসই হতে পারবে না। বর্তমানে মাত্র ১০টি ব্যাংক মিলে মোট খেলাপি ঋণের ৭৫ শতাংশ বহন করছে, বিশেষত কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত ও শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক মারাত্মক সংকটে রয়েছে।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘এটাই বাস্তবতা—বিগত সরকারের সময়ে সৃষ্ট অব্যবস্থাপনার ফল এখন পুরো আর্থিক খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। পুনরুদ্ধারে সময় লাগবে।’
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন